গ্রেনেড হামলার দায় এড়াতে পারেন না খালেদা: প্রধানমন্ত্রী

জাতীয় বিশেষ সংবাদ লীড

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: ২০০৪ সালের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া তার দায় এড়াতে পারেন না। তার যে দায়-দায়িত্ব ছিল তা অস্বীকার করা যায় না।

‘বাবর তো স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিল; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া। যদিও খালেদা জিয়াকে এ মামলায় আসামি করা হয়নি। কিন্তু তখন সে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে ছিলেন।’

বুধবার রাজধানীর ফার্মগেট খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে একুশে আগস্ট উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

ওই হামলায় বিএনপি-জামায়াত সরকার জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের একটা পরিস্থিতি দিনে-দুপুরে কীভাবে ঘটতে পারে, বিএনপি সরকার ক্ষমতায়- তাদের মদদ ছাড়া এটা হতে পারে না। কাজেই এ ঘটনার পর তাদের তো ধারণা ছিল, আমি মারা গেছি; গ্রেনেড ট্রাকের ওপর পড়তে পারত; কিন্তু সেখান থেকে বাড়ি খেয়ে বাইরে পড়ে যায়। যদি ট্রাকের ওপর পড়ে তখন আমরা সবাই শেষ হয়ে যাই। সেখান থেকে যখন গাড়িতে উঠতে যাই, গাড়িতে ওঠার সময় আবার গুলি করে। মাহবুবের (ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী) গায়ে গুলি লাগে।’

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে যেখানে সবসময় মঞ্চ করা হয়, এদিন একটু সামনে এগিয়ে যায় ট্রাক। এটা আল্লাহর ইশারা, না হলে ট্রাক আরও সামনে এগিয়ে যাবে কেন!’

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘এ হামলার আগে খালেদা জিয়ার প্রতিটি বক্তব্যে একটাই কথা ছিল, শেখ হাসিনা ১০০ বছরেও ক্ষমতায় যেতে পারবে না। যাক আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর, মানুষ বোঝে না- আল্লাহর ক্ষমতা কত- সে (খালেদা জিয়া) যে অভিশাপ আমাকে দিয়েছিল, তার জন্যই তা বাস্তব হয়েছে।’

ভয়াল গ্রেনেড হামলার মূল টার্গেটে থেকেও অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি শুধু এটুকুই বলব, আমি বেঁচে আছি। সেদিন একটা নয়, ১৩টি গ্রেনেড ছোড়া হয়। ১২টিই বিস্ফোরিত হয়। বেঁচে থাকার কথা নয়, তারাও ভেবেছিল আমি বেঁচে নাই; যারা হামলা করেছে তারা সেখান থেকে ফোন করেছে, আমি মারা গেছি।’

‘২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ড পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতা’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমার পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হলো। আমি ও আমার ছোট বোন রেহানা, আমাদেরকেও হত্যা করা হতো। আমাদের বাসায় গুলি করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা দুই বোন জার্মানিতে গিয়েছিলাম। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে এতিম হয়ে যাই। সব হারিয়ে আমরা আর দেশে আসতে পারিনি। পাসপোর্টটাও জিয়াউর রহমান সরকার রিনিউ করতে দেয়নি। আমি দেশে চলে আসলাম, আমি জানি দেশে যেকোনো মুহূর্তে আমার ওপর হামলা হবে। আমি দেশে এসেছিলাম একটি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে; এই বাংলার মাটিতে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড হয়েছিল সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার- সে অপরাধের বিচার করতে হবে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল- বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে থাকতে না পারে, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হয়- স্বাধীনতাবিরোধীরা বলতে পারে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন করে ভুল করে গেছে।’

পঁচাত্তরের জাতির পিতাকে হত্যায় অন্যদের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জিয়াউর রহমান এর প্রত্যক্ষ অপরাধী। জিয়াউর রহমান ছিল মোস্তাকের বিশ্বস্ত সহযোগী। জিয়া ১৫ আগস্ট হত্যার বিচারের রাস্তা বন্ধ করেছিল। অপরাধীদের বিদেশে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল; বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাদের কোয়ালিফিকেশন ছিল জাতির পিতার হত্যাকারী! ওই খুনিদের রাজনীতি করার অধিকার দেয়া হয়েছিল, তাদের সংসদে নির্বাচিত করে রাখা হয়েছিল।’

১৯৮১ সালে দেশে ফেরার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি সেই মুহূর্তে দেশে ফিরে এসেছিলাম একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা, জনগণের ওপর আস্থা রেখে। শুধু একবার না বারবার এই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই ঢাল হিসেবে আমাকে বাঁচিয়েছে। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আঘাত আসেনি।

২১ আগস্টের শান্তির সমাবেশের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা একটা র‌্যালি করতে চেয়েছিলাম। শান্তি র‌্যালি। সিলেট শাহজালালের মাজারে হামলা হয়েছিল। বৃটিশ হাইকমিশনারের ওপর হামলা হয়েছিল। গোপালগঞ্জে বোমা হামলা। এসব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা শান্তির মিছিল করতে চেয়েছিলাম, র‌্যালি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অনুমতি দেয়া হয়নি। প্রোগ্রামের আগে রাত ১২টায় অনুমতি দেয়া হলো। পরে আমরা দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে র‌্যালি করার সিদ্ধান্ত নেই। সেখানে গ্রেনেড হামলা হলো।

গ্রেনেড হামলার দিনের স্মৃতিচারণা করে শেখ হাসিনা বলেন, অন্যান্য সময় আমাদের ভলান্টিয়াররা আশেপাশের ছাদের ওপরে পাহারায় থাকে। সেদিন কাউকে উপরে উঠতে দেয়া হয়নি, পুলিশ বাধা দিয়েছিল। ফটোগ্রাফার গোর্কি এসে বলল, আমি ছবি নিতে পারিনি। গোর্কির বাবাকে আমি চিনতাম, তিনি অবজারভারের ফটোসাংবাদিক ছিলেন। অন্য সাংবাদিকরাও চিৎকার করছিলেন, ছবি পাইনি। এই ছবি তুলতে গিয়ে কয়েকটা সেকেন্ড দাঁড়ানো, এর মধ্যেই গ্রেনেড হামলা শুরু হয়ে গেল।

গ্রেনেড হামলা-পরবর্তী অবস্থার বিবরণ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমার চোখে সমস্যা ছিল, চশমাটা পড়ে গিয়েছিল। আমি দেখতে পারছিলাম না ভালোমতো। আমি যখন স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে বের হলাম, তখন টিয়ারশেল মারা হচ্ছিল, আমাদের নেতাকর্মীরা যখন সহযোগিতায় ছিলেন তখনই পুলিশ টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ করে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

উষ্মা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, কোথাও যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে পুলিশের দায়িত্ব থাকে, দোষীদের ধরা বা যারা নির্যাতিত তাদের সাহায্য করা; কিন্তু এখানে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। সেখান থেকে আক্রমণকারীরা যাতে সহজে বের হয়ে যেতে পারে, সেই সুযোগ তারা (পুলিশ) করে দিয়েছিল। জেলখানায়ও একটা গ্রেনেড পাওয়া গেল। জেলখানা থেকেও লোক এনে আক্রমণ করিয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে এসেছিল চিকিৎসা করানোর জন্য। কিছু গ্রেনেড, সেগুলো তারা জেলখানায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তাহলে কত গ্রেনেড ছিল তাদের? রামনাতেও একটি গ্রেনেড পাওয়া যায়।

‘তৎকালীন সরকার এ হামলার সব আলামত ধ্বংস করে দিয়েছিল’ অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই ঘটনার পরের দিনই সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি এনে সমস্ত কিছু ধুয়ে ফেলা হয়। আলামত নষ্ট করার জন্য। আমরা কিছু আলামত রক্ষা করার চেষ্টা করি। সরকারের উচিত ছিল আলামত সংরক্ষণ করা; কিন্তু সেটা না করে তারা ধুয়ে-মুছে দিয়েছিল। কোনো এক আর্মি অফিসার একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড আলামত হিসেবে রাখতে চেয়েছিল, সে চাকরি হারায়। এই ঘটনার পর কোনো আলামতই যেন না থাকে সে চেষ্টাই করা হয়।’

‘হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়। নাম জয়নাল আবেদীন। তাদের মতো করে একটি ফরমায়েশি রিপোর্ট দেয়া হয়। সেই ঘটনায় একজন সাধারণ মানুষকে নিয়ে, জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়। এখন সবই বের হচ্ছে। সেই জজ মিয়াকে নিয়ে এসে তাকে টর্চার করে কথা বলানো হয়। সে একজন সাধারণ মানুষ, এত গ্রেনেড কীভাবে নিয়ে আসে?’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো রোগীকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তাদের ইমারজেন্সি ছিল না বলে বের করে দেয়া হয়। বিএনপিপন্থী কোনো ডাক্তার সেখানে যায়নি। আমাদের যেসব ডাক্তার, তারাই কাজ করেছেন। আমাদের লোকজন রক্ত দিয়েছে, আমি চেষ্টা করেছি, আমাদের যেসব ডাক্তার আছে, আমি সব জায়গায় জানার চেষ্টা করেছি, কোথাও আমাদের লোকেরা চিকিৎসা ছাড়া আছে কি-না। অনেককে দেশের বাইরেও চিকিৎসা করিয়েছি।’

হামলার পর বিএনপির দায় চাপানোর সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এরপর বলা হলো কী; শেখ হাসিনা হ্যান্ডব্যাগে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে। এই কথাটাই স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছে পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হলো। মনে হলো, আমরা সেখানে সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম।’

নিজের দৃঢ়তার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মৃত্যু আসবে, সেটা অবধারিত জানি; কিন্তু সেই মৃত্যুভয়ে আমি বসে থাকব না। জাতির পিতা যেভাবে ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন, সেভাবেই দেশের সেবা করে যাব। জাতির পিতার আদর্শে বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, সেটাই আমার চাওয়া।’

আলোচনা মঞ্চে উপস্থিত আহত ও নিহতদের স্বজনদের ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, মঞ্চে যারা রয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন, অনেকে আপনজন হারিয়েছেন। মানুষ একটা শোক সইতে পারে না। আমি সবাইকে হারিয়েছি। দেশের মানুষের আত্মত্যাগের কথা আমরা সবসময় স্মরণ করি।

সভা সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমীন। সভায় সূচনা বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

আলোচনায় আরও অংশ নেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাহারা খাতুন, নির্বাহী সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য এস এম কামাল হোসেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজি আবুল হাসনাত, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান প্রমুখ।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *