স্বদেশবাণী ডেস্ক: অ্যাপসভিত্তিক ডিজিটাল মাইক্রো ফাইন্যান্সের নামে সুদ ব্যবসার আড়ালে একটি চক্র গ্রাহকের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য সংগ্রহ করছে। এই চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
মোবাইলে তাদের অ্যাপস ইনস্টল করলেই গ্রাহকের অজান্তে তাদের অনেক গোপনীয় তথ্য পেয়ে যায় চক্রটি। যেসব তথ্য তারা নেয়, তার মধ্যে রয়েছে- ক্যালেন্ডারের ইভেন্ট, গ্রাহকের অনুমতি ব্যতিরেকে দূর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গ্রাহকের মোবাইল ক্যামেরা ব্যবহার করে ছবি ও ভিডিও ধারন।
মোবাইলের কন্টাক্টস পড়াসহ মোবাইলের এক্সাক্ট লাইভ লোকেশন নির্ণয় ও ফোনের স্ট্যাটাস। অ্যাপস ইনস্টল করলে ফোনে সংরক্ষিত মেসেজ পড়া ও পরিবর্তন করার সুযোগ পেয়ে যায় তারা। এক্ষেত্রে গ্রাহকের পারসোনাল ডাটা সিকিউরিটি চরম হুমকিতে পড়ে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার। গ্রেফতার হওয়া পাঁচজন হলো-ইমানুয়্যাল এডওয়ার্ড গোমেজ, আরিফুজ্জামান, শাহিনূর আলম ওরফে রাজীব, শুভ গোমেজ ও মো. আকরাম।
মঙ্গলবার ও বুধবার ধারাবাহিক অভিযানে ঢাকা মহানগরীর ধানমন্ডি, বনানী এবং মিরপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। গ্রেফতার হওয়াদের কাছ থেকে একটি অ্যাশ রংয়ের এলিয়ন গাড়ি, নয়টি মোবাইল ফোন, নয়টি সিম কার্ড, চারটি ল্যাপটপ ও চারটি বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই জব্দ করা হয়েছে।
ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, গ্রেফতার হওয়ারা সরকারি অনুমোদন ছাড়াই থান্ডার লাইট টেকনোলজি লিমিটেড, নিউ ভিশন ফিনটেক লিমিটেড ও বেসিক ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির নামে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। তারা বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে জামানতবিহীন লোন দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত সুদ নিয়ে থাকে। এসব অ্যাপসের সার্ভার চীনে অবস্থিত এবং সেখান থেকে পরিচালিত হয়।
অ্যাপসগুলোর মাধ্যমে জামানতবিহীন স্বল্প সুদে লোন প্রদান করার নামে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা হয়। চীনের ও বাংলাদেশের কিছু নাগরিক এতে জড়িত। তাদের বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে গ্রাহকরা লোন গ্রহণ করার পর স্বল্প সুদের পরিবর্তে উচ্চহারে সুদ প্রদানের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন। প্রতারণার শিকার এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ধানমন্ডি থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়। এ মামলা তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।
তিনি বলেন, গ্রেফতার হওয়ারা অ্যাপসের মাধ্যমে ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বল্প সুদে জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে। তারা মূলত অর্থ সংকটে থাকা স্বল্প আয়ের লোকজন এবং বেকার ছাত্রছাত্রীদের টার্গেট করে।
টার্গেটকৃতারা বিজ্ঞাপনে প্রদর্শিত লিংকে ক্লিক করে কিংবা গুগল স্টোর থেকে অ্যাপসগুলো ডাউনলোড করে। সেখানে বেশকিছু বিষয়ে অনুমতি চাওয়া হয়। এতে সম্মতি দিলেই অ্যাপসটি গ্রাহকের মোবাইলে ইনস্টল হয়ে যায়। এরপর গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র, ফোন নাম্বার, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ফোন নাম্বার ও তাদের ব্যক্তিগত তথ্যসহ অন্যান্য তথ্য দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়।
চাহিদা অনুযায়ী আবেদনের প্রেক্ষিতে মাত্রাতিরিক্ত প্রসেসিং ফি নিয়ে এবং উচ্চ হারে সুদ নির্ধারণ করে স্বল্প সময়ের জন্য ৩ থেকে ৭ দিনের জন্য ঋণ প্রদান করে।
ঋণ দেওয়ার কৌশলের বিষয়ে ডিবির কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহক তিন হাজার টাকার জন্য আবেদন করলে অনুমোদনের পর প্রসেসিং ফি বাবদ ৮১০ টাকা রাখা হয়। গ্রাহককে দেওয়া হয় মাত্র ২ হাজার ১৯০ টাকা। ৭ দিন শেষে গ্রাহককে পরিশোধ করতে হয় মোট ৩ হাজার ১৮ টাকা।
মেয়াদ শেষে অনাদায়ে প্রতিদিন হিসাবে গ্রাহককে উচ্চহারে সুদ প্রদান করতে হয়। এ ছাড়াও অ্যাপ্লিকেশন ফি বাবদ ১২০ টাকা, ডাটা অ্যানালাইসিস ফি ১৮০ টাকা, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১৫ টাকা এবং সুদ বাবদ ৫ টাকা কেটে রাখার যুক্তি দেখায়। তবে পরিমাণ যত বেশি হবে টাকা কেটে রাখার প্রবণতাও বেশি। এ ঋণের টাকা গ্রাহককে বিকাশ অথবা নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই। প্রতারকদের এ লোভনীয় অফারের ফাঁদে পড়ে অনেকে সর্বস্ব হারিয়েছেন।
এ অবস্থায় যে কোনো অ্যাপস ইনস্টল করার আগে ও পরে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের মতে, অ্যাপস অথবা কোনো লিংকে প্রবেশ করার পর ব্যক্তিগত কোনো তথ্যাদি দেওয়ার আগে নিরাপত্তার বিষয়টি ভালোভাবে নিশ্চিত হতে হবে। ব্যক্তিগত তথ্য যত্রতত্র শেয়ার করা যাবে না।
ডিবি জানায়, গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম অভিযানটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন। অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ফজলুর রহমানের সার্বিক তদারকিতে ওয়েব বেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশ টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আশরাফ উল্লাহর নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হয়।