স্বদেশ বাণী ডেস্ক: মঞ্চটা প্রস্তুতই ছিল। সব আয়োজনও ছিল ঠিকঠাক। কিন্তু চিত্রনাট্যের শেষ দৃশ্যায়নটাই যে হলো না! মিরপুরে হলো না ফ্লোরিডার পুনরাবৃত্তি।
বেশিদিন আগের কথা নয়। নিজেদের আগের টি-টোয়েন্টি সিরিজে গত আগস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেন্ট কিটসে প্রথম ম্যাচটা হেরেছিল বাংলাদেশ। ভেন্যু বদল হতে বদলে যায় বাংলাদেশও। শেষ দুই ম্যাচ খেলতে দল যায় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়।যেখানে টানা দুই ম্যাচ জিতে সিরিজ জয়ের উৎসব করে বাংলাদেশ দল।
একই রকম গল্প হতে পারত দেশের মাটিতেও। সিলেটে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশ দল পা রাখে ঢাকায়। মিরপুরে দ্বিতীয় ম্যাচে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে সিরিজ জয়ের আশা বাঁচিয়ে রাখে দল।শনিবার শের-ই-বাংলায় শেষ ম্যাচে তাই ফ্লোরিডার পুনরাবৃত্তির অপেক্ষায় ছিল গোটা দেশ। কিন্তু সাকিব-মুশফিকরা পারলেন না।
অথচ ভালো সুযোগই ছিল বাংলাদেশের সামনে। আগে ব্যাট করতে নামা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭.১ ওভারে একশ তুলে ফেলার পরও দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের দুইশর আগে থামিয়ে দিয়েছিলেন বোলাররা।১৯১ রানের লক্ষ্যে তামিম ইকবালের বিদায়ের পরও লিটন দাস ও সৌম্য সরকারের ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ কক্ষপথে ছিল ভালোভাবেই।
কিন্তু আম্পায়ারের দুটি বড় ভুল সিদ্ধান্তে মিরপুরে ছড়াল তুমুল উত্তেজনা। বাংলাদেশের পথ হারানোরও শুরু এরপরই। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল ব্যাটিং। তাতে বাংলাদেশ যেতে পারল না লক্ষ্যের ধারেকাছেও। ১৪০ রানেই থেমে গিয়ে ম্যাচ হারল ৫০ রানে, তখনো তিন ওভার বাকিই!
লক্ষ্য তাড়ায় বাংলাদেশের শুরুটা হয়নি ভালো। দ্বিতীয় ওভারেই রান আউটে কাটা পড়েন তামিম ইকবাল। ওশানে টমাসকে স্কয়ার লেগে খেলেছিলেন লিটন দাস। তৃতীয় রান নিতে গিয়েছিলেন তামিম। রোভম্যান পাওয়েলের থ্রো থেকে স্টাম্প ভেঙে দেন উইকেটকিপার শাই হোপ। তামিম তখন বেশ দূরেই (৮)।
২২ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙার পর আগের ম্যাচের মতো আবারো দ্বিতীয় উইকেটে দারুণ জুটি গড়ে তোলেন লিটন দাস ও সৌম্য সরকার। আগের ম্যাচে ৩৪ বলে ৬০ রান করা লিটন ঝড় তোলেন এদিনও।টমাসকে পুল, কাট, স্ট্রেইট শটে তিনবার আছড়ে ফেলেন সীমানার ওপারে।
এর মধ্যেই চতুর্থ ওভারে আম্পায়ারের ভুল সিধান্তে উত্তেজনা ছড়ায় মিরপুরে। টমাসের তিন বলের মধ্যে দুবার ওভার স্ট্রেপিংয়ের ‘নো’ বলের ভুল সিদ্ধান্ত দেন আম্পায়ার তানভীর আহমেদ। দ্বিতীয়টায় আবার মিড অফে ক্যাচ দেন লিটন।দুবারই টিভি রিপ্লেতে স্পষ্ট দেখা যায়, টমাসের পায়ের অনেকটা অংশ পপিং ক্রিজের ভেতরেই ছিল।
প্রতিবাদ জানান ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ব্রাফেট। মাঠের আম্পায়ারদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা চলে তার। মাঠের পাশে নেমে আসেন চতুর্থ আম্পায়ার সৈকত। তার কাছেও প্রতিবাদ জানান উত্তেজিত ব্রাফেট। পরে মাঠে আসেন ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রোও। তুমুল উত্তেজনার পর শেষ পর্যন্ত টিকে যায় আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত।
আট মিনিট বন্ধ থাকার পর আবার খেলা শুরু হলে ধস নামে বাংলাদেশের ইনিংসে। আট বলের মধ্যে বাংলাদেশ হারায় ৩ উইকেট। বাঁহাতি স্পিনার ফ্যাবিয়ান অ্যালেনকে উড়াতে গিয়ে সৌম্য লং অনে ক্যাচ দিলে ভাঙে ৪৩ রানের জুটি। পরের বলে একই রকম শটে গোল্ডেন ডাকের স্বাদ নিয়ে ফেরেন অধিনায়ক সাকিব।
পরের ওভারে পেসার কিমো পলকে কাট করে পয়েন্টে সহজ ক্যাচ দেন মুশফিকুর রহিম। মাহমুদউল্লাহর মুখোমুখি প্রথম বলে চার হাঁকালেও ইনিংস বড় করতে পারেননি। পলের পরের ওভারেই তিনি ১১ রান করে ফেরেন মিড অফে ক্যাচ দিয়ে। একটা সময় ১ উইকেটে ৬৫ থেকে বাংলাদেশের স্কোর তখন ৫ উইকেটে ৮০!
তখনো একপ্রান্তে ভরসা হয়ে টিকে ছিলেন লিটন। পলের পরের ওভারে তিনিও মিড অফে সহজ ক্যাচ দিয়ে ফেরেন (২৫ বলে ৪৩)। আরিফুল হক মুখোমুখি প্রথম বলে বাজে শটে আউট হলে স্কোরটা হয়ে যায় ৭ উইকেটে ৮৯! এরপর মেহেদী হাসান মিরাজের ১৯ ও আবু হায়দার রনির অপরাজিত ২৫ রানের সুবাদে পরাজয়ের ব্যবধানই কমে শুধু।
এর আগে এদিন টস ভাগ্য পাশে পেয়েছিল বাংলাদেশ। টস জিতে বোলিং নেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। তবে বোলিংয়ের শুরুটা ভালো হয়নি মোটেই। আগের দুই ম্যাচে বড় ইনিংস খেলতে না পারা লুইস তোলেন ঝড়। সেই ঝড়টা সবচেয়ে বেশি গেছে একের পর এক হাফ ভলি বল করা আবু হায়দার রনির ওপর দিয়ে।
প্রথম ওভারেই বাঁহাতি পেসারকে দুই চার হাঁকিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন লুইস। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান রনির পরের ওভারে হাঁকান চারটি ছক্কা! এর মধ্যে প্রথম তিনটি ছিল পরপর তিন বলে। এই ওভারে রনি খরচ করেন ২৭ রান, যা টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের কোনো বোলারের এক ওভারে চতুর্থ সর্বোচ্চ।
মিরপুরে চার-ছক্কার বৃষ্টি নামিয়ে লুইস ফিফটি পূর্ণ করেন মাত্র ১৮ বলে।অবশ্য ৪৮ রানেই আউট হয়ে যেতে পারতেন তিনি। চতুর্থ ওভারে মেহেদী হাসান মিরাজকে পরপর চার-ছক্কা হাঁকিয়ে পরের বলে ক্যাচ তুলেছিলেন মিড উইকেটে। সহজ ক্যাচটা নিতে পারেননি রনি।
ঝড়ের গতিতে রান তুলতে থাকা ৭৬ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন সাকিব। পঞ্চম ওভারে প্রথমবারের মতো আক্রমণে আসা বাঁহাতি স্পিনারের শেষ বলে সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড শাই হোপ (১২ বলে ২৩)।
ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পেয়ে তিন নম্বরে উঠে এসেছিলেন কিমো পল। তবে ডানা মেলার আগেই তাকে ফিরিয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান। বাঁহাতি পেসারকে পুল করতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে ক্যাচ দেন ২ রান করা পল।
লুইস অবশ্য ততক্ষণে আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন। কত বলে তিনি ক্যারিয়ারের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি করেন, সেটা নিয়েই তখন সবার আগ্রহ। ৯ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোরবোর্ডেও উঠে গেছে ১২০ রান, ২ উইকেট হারিয়ে।
এরপরই বোলিং ইনিংসে বাংলাদেশের সেরা মুহূর্তটা আসে। দশম ওভারে মাহমুদউল্লাহকে আক্রমণে আনেন অধিনায়ক। অফ স্পিনার দ্বিতীয় বলেই তুলে নেন সবচেয়ে বড় উইকেটটা। সেঞ্চুরি থেকে ১১ রান দূরে থাকতে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড লুইস। ৩৬ বলে ৬ চার ও ৮ ছক্কায় ৮৯ রানের ইনিংসটা সাজান বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
পরের বলে শিমরন হেটমায়ারকে গোল্ডেন ডাকের স্বাদ দিয়ে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনাও জাগিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। এলবিডব্লিউয়ের বিপক্ষে রিভিউ নিয়েও উইকেট বাঁচাতে পারেননি সীমিত ওভারের সিরিজে ব্যর্থতার খোলসে বন্দি থাকা হেটমায়ার।
বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরুটা ওই ওভারেই। পঞ্চম উইকেটে রোভম্যান পাওয়েল ও নিকোলাস পুরাণের ৩৭ রানের জুটিতে দুইশর আশা বেঁচেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। কিন্তু এ জুটি ভাঙার পর আর দাঁড়াতে পারেননি কেউই।
পাওয়েলকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন মাহমুদউল্লাহ। প্রথমবারের মতো তিনি নেন তিন উইকেট। মুস্তাফিজ একই ওভারে ফেরান পুরাণ ও কার্লোস ব্রাফেটকে। ১৯তম ওভারে সাকিব চার বলের মধ্যে তুলে নেন ফ্যাবিয়ান অ্যালেন ও অভিষিক্ত শেরফান রাদারফোর্ডকে। শেষ ওভারে মাহমুদউল্লাহর দ্বিতীয় বলে ওশানে টমাসের রান আউটে শেষ সফরকারীদের ইনিংস।
পাওয়েল (১৯) ও পুরাণের (২৯) পর আর কেউই দুই অঙ্কে যেতে পারেননি। ৬৮ রানে শেষ ৮ উইকেট তুলে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুইশ আগেই থামায় বাংলাদেশ। সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও মুস্তাফিজের শিকার ৩টি করে উইকেট।
কিন্তু বোলারদের দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানোটা পূর্ণতা দিতে পারলেন না ব্যাটসম্যানরা। প্রথমবারের মতো কোনো দ্বিপক্ষীয় সিরিজে প্রতিপক্ষকে তিন সিরিজেই হারানোর স্বাদটাও পাওয়া হলো না, জয়ে রাঙানো হলো না বছরের শেষটা। টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজ হারের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ দেশে ফিরছে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের আনন্দ নিয়ে।