তীব্র অর্থ সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এ সংকটের কারণে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে কেনা বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল, ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) ও পাবলিক কোম্পানির মালিকানাধীন বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের দু-তিন মাসের বিল বকেয়া পড়েছে বিপিডিবির কাছে। বকেয়ার এ পরিমাণ সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে বিপিডিবি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে।
রেন্টাল, কুইক রেন্টাল, আইপিপি ও পাবলিক কোম্পানির মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনে বিপিডিবি। জাতীয় সঞ্চালন গ্রিডের মাধ্যমে এ বিদ্যুৎ তারা বিক্রি করে বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির কাছে। উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো বিপিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বিল নেয়। সাধারণত এক মাসে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ জাতীয় সঞ্চালন গ্রিডের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিগুলো বিক্রি করে, তার বিল পরের মাসের ১০ তারিখের মধ্যে বিপিডিবিতে দাখিল করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ১০ থেকে মাসের শেষ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের হিসাবে বিল পাঠায় বিপিডিবি।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সূত্র বলছে, দুই মাস ধরে বিদ্যুৎ দিলেও বিল পাচ্ছে না তারা। জুলাইয়ের বিল এখন পর্যন্ত পরিশোধ হয়নি বলে জানিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানি। কিছু কোম্পানিকে বিল দেয়া হলেও অধিকাংশ কোম্পানি এখন পর্যন্ত তাদের বিল পায়নি। জুলাই ও আগস্টের বিদ্যুৎ বিল হিসেবে বিপিডিবির কাছে বিভিন্ন কোম্পানির পাওনা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার উপরে। বকেয়া টাকা বেড়ে গেলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হচ্ছে কোম্পানিগুলোকে।
জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, যে অর্থ সংকট, তা খুব বড় নয়। আমাদের তো বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকের কাছে কম দামে বিক্রি করতে হয়। এজন্য প্রতি ইউনিটে দেড় টাকার মতো ঘাটতি থাকে। এ টাকাটা সরকার আমাদের বাজেটারি সাপোর্ট হিসেবে দেবে। সেটা পেলেই কোম্পানিগুলোর বকেয়া পরিশোধ হয়ে যাবে।
এদিকে বিদ্যুৎ বিক্রির অর্থ না পেয়ে বিপাকে পড়েছে বেসরকারি উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে পাওয়া টাকাই তাদের আয়ের উৎস। এ দিয়েই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালন ব্যয় সংকুলান করে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু গত দুই মাসের বিল আটকে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে তারা।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, বিপিডিবির তারল্য সংকট যদি ক্রমেই বাড়তে থাকে আর বকেয়ার পরিমাণও বড় হতে থাকে, তাহলে এসব কোম্পানিকে দেউলিয়া হতে হবে। কারণ বিপিডিবি ছাড়া বিদ্যুৎ বিক্রির দ্বিতীয় কোনো গ্রাহক নেই তাদের।
দুই মাসের বিল না পাওয়ার কথা স্বীকার করেন বারাকা পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রাব্বানী চৌধুরী। আরো একাধিক বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও দুই মাস ধরে বিল না পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। এমনকি যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাংকঋণ রয়েছে, ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তার কথাও জানিয়েছে তারা।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে উৎপাদনে আছে মোট ১২৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৪১। বাকি ৮২টি রেন্টাল, কুইক রেন্টাল, আইপিপি ও স্মল ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (এসআইপিপি), যেগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনছে বিপিডিবি। এর মধ্যে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ২৭টি এবং আইপিপি ও এসআইপপি ৪৬টি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫৪টিই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে ফার্নেস ও ডিজেল অয়েল, যা সবচেয়ে ব্যয়বহুল।
এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবির গড় ব্যয় ৬ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে ৪ টাকা ৮৪ পয়সায়। ফলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে বিপিডিবির ঘাটতি থাকছে ১ টাকা ৪১ পয়সা। বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে কেনা বিদ্যুতের বিপরীতে প্রতি মাসে এ ঘাটতি দাঁড়ায় ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা, যা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া অনুদানে পরিশোধ করে বিপিডিবি।
বিপিডিবির সদস্য (প্রশাসন) ও ভারপ্রাপ্ত সদস্য (অর্থ) জহুরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যে অনুদান দেয়া হয়, সে টাকাটা আসতে বিলম্ব হওয়ায় একটু সমস্যা হচ্ছে। টাকাটা পেলেই সমস্যা কেটে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে এ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বিপিডিবিকে। এসব কেন্দ্র থেকে বেশি বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে তারল্য সংকটের পাশাপাশি লোকসান বাড়ছে সংস্থাটির। কারণ ডিজেলভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ২৬ টাকা ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক গড়ে ১১-১২ টাকা, যেখানে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় দুই থেকে আড়াই টাকা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, পিডিবির যে সংকট, তার জন্য দায়ী মূলত তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে যাওয়া। নিয়মিত ভর্তুকি না পাওয়াও এর আরো একটি কারণ। এ পরিস্থিতি যদি আরো কয়েক মাস চলে, তাহলে জরিমানাসহ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে বিপিডিবির দেনা আরো বাড়বে।
জানা গেছে, গত বছর থেকে এ পর্যন্ত তেলভিত্তিক বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করায় এবং এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনায় বিপিডিবির ঘাটতি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমেই বাড়তে থাকায় জ্বালানির মূল্য পরিশোধেও চাপ বাড়ছে বিপিডিবির ওপর। সব মিলিয়ে ঘাটতির পরিমাণও বাড়ছে। এছাড়া যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এখন বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে, চুক্তির সময় প্রতিযোগিতাপূর্ণ দরকষাকষি না হওয়ায় ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে যদি চুক্তি করা হতো, তাহলে আরো কম দামে বিপিডিবি বিদ্যুৎ কিনতে পারত। ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যকার যে ঘাটতি, তাও কমে আসত তখন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ম তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন যখন বেড়ে যায়, তখন এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যদিও চাহিদা পূরণে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ ছাড়া উপায় ছিল না। তবে এভাবে ছয় মাস চলতে থাকলে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হবে।
উল্লেখ্য, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কিনে লোকসান গুনছে বিপিডিবি। ব্যক্তিখাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে না আসার কারণে সংস্থাটির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। প্রতি বছরই গড়ে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে বিপিডিবি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিপিডিবিই একমাত্র লোকসানি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিপিডিবির লোকসানের পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। তার আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৩৪ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ হাজার ৮৬৬ কোটি ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। গত ১০ বছরেই বিপিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।