শান্তির শহর নামে পরিচিত বিভাগীয় শহর রাজশাহী জাতীয় সংসদের ৫৩ নম্বর আসন। পদ্মাতীরের এই শহর জেলার ২ নম্বর নির্বাচনী এলাকা। নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। নভেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্ধী বিএনপি জোট এখনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেয়নি। ফলে তৎপর রয়েছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। নবম সংসদ নির্বাচনেও তিনি তখনকার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের টিকিটে নির্বাচিত হন। কিন্তু আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা আসনটি শরিকদের ছেড়ে দিতে নারাজ।
মনোনয়ন দৌড়ে পরপর দুবার আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ নির্বাচিত হয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা এখন জোটের প্রধান শরিক ক্ষমতাসীন দলে বেশ প্রভাব বিস্তার করে আছেন। এছাড়াও মনোনয়ন দৌড়ে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য ও নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মীর ইকবাল ও মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের নাম যেমন আছে, তেমনি সামাজিকভাবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহীন আকতার রেনীর নামও এসেছে। জাতীয় চারনেতার অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান পরিবারের সদস্য ও রাসিক মেয়রের সহধর্মিণী হিসেবে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণে সফল হয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা দৌড়ে মহানগর যুবলীগের সভাপতি রমজান আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আহসানুল হক পিন্টু ও মহানগর ছাত্রলীগ সাবেক সভাপতি জয় পরিষদ আহ্বায়ক শফিকুজ্জামান শফিকের নাম শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ বজলুর রহমানও মনোনয়ন চাইতে পারেন। তিনি বর্তমানে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়াকার্স পার্টির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা ২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দিতায় পুনরায় নির্বাচিত হন। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছেন তিনি। তবে এবারও নিজ দলের সামান্যকিছু ভোটের চেয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপরই ভরসা করতে হবে তাঁকে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার দুরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় নির্বাচনে সুবিধা আদায় করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন এখানকার তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
এদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, টানা দুইবার সাংসদ থেকে ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহীর উন্নয়নে তেমন কোন চমক দেখাতে পারেননি। মূল্যায়ন করেননি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। বাদশার সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। তাই এবার তারা নিজ দলীয় প্রার্থী চান, বাদশাকে ছাড় দিতে নারাজ। এই অবস্থায় আগামী নির্বাচনে ফজলে হোসেন বাদশাকে মনোনয়ন না দিয়ে আওয়ামী লীগেরই কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এরই মধ্যে রাজশাহী-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে নানাভাবে মাঠে নেমে পড়েছেন অন্তত হাঁফ ডজন খানেক নেতা। তারা বিভিন্নভাবে গণসংযোগ চালাচ্ছেন।
তবে সাংসদ বাদশার অনুসারীরা বলছেন, এখানে বাদশার মনোনয়ন অনেকটাই নিশ্চিত। কেন্দ্রীয় মহাজোটে বাদশার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। দুই মেয়াদে সাংসদ বাদশা রাজশাহীর উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ ও অসা¤প্রদায়িক চেতনায় এ অঞ্চলের মানুষকে উজ্জীবিত করতে বাদশার অবদান অসামান্য। এ ছাড়া দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই আর সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ বাদশার প্রতি রয়েছে মানুষের ভালোবাসা। এ আসনের ভোটাররা তাকে স্বজন ব্যক্তি হিসেবেই জানেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার রাজশাহী বিমানবন্দর এবং রেশম কারখানা বন্ধ করে দেয়। ফজলে হোসেন বাদশা তার নির্বাচনী অঙ্গীকারে এ দুটি প্রতিষ্ঠান চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, বিমানবন্দর চালু করেন বাদশা। রেশম কারাখানাও চালুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আর তাই রাজশাহীর জনমত বাদশার পক্ষে রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানা দুইবার সাংসদ থেকে একসময় রাজশাহীর বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া নেতা ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহী শহরের সাধারণ মানুষের মনে তেমন দাগ কাটতে পারেননি ।
তারা বলেন, রাজশাহী শহরের উন্নয়নের রূপকার ধরা হয় একসময়ের মেয়র বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিনুকে। এরপর সেই উন্নয়নের ধারা আরো বেগবান করেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। কিন্তু এর পরও বিভাগীয় এই শহরে তেমন কলকারখানা গড়ে না ওঠায় উন্নয়নের দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে শিক্ষা নগরী রাজশাহী। তাদের মতে, শহরটি কাঙ্খিত উন্নয়নের দিক থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। আর এর অন্যতম কারণ হলো বিভাগীয় শহর হলেও রাজশাহী থেকে দীর্ঘদিন কোনো মন্ত্রী না থাকা। এ জন্য এবার রাসিক নির্বাচনে মহানগর যুবলীগকে ১ থেকে ৩০ নং ওয়ার্ড এর ১৩৮ টি ভোটার কেন্দ্রের প্রচারনা কমিটি তাদের নিজ নিজ ওয়ার্ডে প্রচারনা করে সাধারণ ভোটারদের দোয়ারে দোয়ারে রাসিক মেয়র লিটনের পক্ষে সক্রীয় ভাবে মাঠে কাজ করতে দেখে রাজশাহীর উন্নয়নের জন্য অন্য কোন প্রার্থী নয় মহানগর যুবলীগ থেকেই কোন প্রার্থীকে চান তারা।
রাজশাহীর উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং আগামী নির্বাচন সম্পর্কে সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘জোটে ভাঙন সৃষ্টি করতে কেউ কেউ নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারাই হয়তো আমার বিরুদ্ধে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে। তবে আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, সরকারের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি এমন কোনো অভিযোগ কেউ দিতে পারবে না।
তিনি আরো বলেন, ‘যাঁরা এসব কথা বলছেন, তাঁরা গত তিন বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ আছে। তাঁরা আমার পক্ষে আছেন।
নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মীর ইকবাল বলেন, ‘রাজশাহী একটি বিভাগীয় শহর। জোটের প্রার্থীকে দেশের অন্য যে কোনো আসন দিন, তবে রাজশাহী সদর আসন দলকেই দিতে হবে। প্রার্থী হিসেবে নিজে সব সময় মাঠে আছেন জানিয়ে মীর ইকবাল বলেন, ‘নগরীর সব ওয়ার্ডে গণসংযোগ করছি। আগামীতে আওয়ামী লীগের এমপি হলে নগরীর উন্নয়ন কাজ সহজ হবে।
মনোনয়ন প্রসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, ‘দু’বার ওয়ার্কার্স পার্টির এমপি আছেন। উন্নয়মূলক কাজে দলীয় নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়নি। অথচ আওয়ামী লীগের ভোট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সিটি নির্বাচনে তার প্রমাণ মিলেছে। তৃণমূলের কর্মীরা আওয়ামী লীগের প্রার্থী চাচ্ছে এই ভোটকে কাজে লাগাতে হবে। আর সদর আসনেও আওয়ামী লীগের এমপি থাকলে অনেক বেশি কাজ করা সম্ভব। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত যা আসুক তা মাথা পেতে নেবেন বলে জানান এই আওয়ামী লীগ নেতা।
মহানগর যুবলীগ সভপতি রমজান আলী বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে যুবলীগের শক্তিশালী ভূমিকা আছে। আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড, থানা ও মহানগর কমিটির অধিকাংশ নেতাকর্মীই যুবলীগের রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন। তাদের দাবির কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি। সেভাবে নির্বাচনকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছি। জনগণের দৌরগোড়ায় নৌকা প্রতীকের উন্নয়ন, শেখ হাসিনার উন্নয়ন, লিটন ভাইয়ের উন্নয়ন তুলে ধরছি।
তিনি আরো বলেন, ‘গত নির্বাচনেও প্রার্থী ছিলাম। এবারও প্রার্থী হিসেবে মাঠে কাজ করে যাচ্ছি। আমার সংগঠন যুবলীগের নেতাকর্মীদের সক্রিয় করতে ৩০টি ওয়ার্ডে ১৩৮টি কমেটি করেছি। নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছি। এই অবস্থায় আশা করি দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।
আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী আহসানুল হক পিন্টু বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আমি দীর্ঘদিন ধরেই মাঠে আছি। কাজ করে যাচ্ছি। এভাবেই রাজনীতি করতে চাই। দল সুযোগ দিলে আগামীতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তার প্রতিফলন ঘটাতে চাই।’ তিনিও মনে করেন, রাজশাহী-২ আসনে দলীয় প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেওয়া উচিত।
মহানগর ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, ‘সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা তৃণমূলের কাছে যেমন আস্থার প্রতীক। তেমনভাবে সাধারণের কাছে সমান জনপ্রিয়। সিটি নির্বাচন শুরুর অনেক আগে থেকে মহানগর ছাত্রলীগ সাবেক সভাপতি শফিকুজ্জামান শফিক সাবেক ছাত্রলীগ ফোরামের আহ্বায়ক হিসেবে পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের এক কাতারে আনেন। তার সেই প্রচারণায় জনগণের ব্যাপক সাড়া লক্ষ্য করা গেছে। যারা একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন, অনেকে আওয়ামী লীগের, যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা শফিককে প্রার্থী হিসেবে চাচ্ছেন। আমরা চাই তৃণমূলের কর্মী থেকে উঠে আসা ভালো সংগঠককে মনোনয়ন দেয়া হোক। যারা শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করবে এবং রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে। আমরা বিশ্বাস করি, এবারের প্রার্থী নির্ধারণে বঙ্গবন্ধুকন্যা পরিচ্ছন্ন তরুণ নেতৃত্বকে গুরুত্ব দেবেন।