ইউরোপের রাজনীতিতে হঠাৎ উগ্র ডানপন্থিদের উত্থান কেন?

আন্তর্জাতিক লীড

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইতালির নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থি জোটের বিপুল বিজয় চমকে দিয়েছে সবাইকে। একসময় যে ইউরোপকে বলা হতো উদারপন্থি গণতন্ত্রের দুর্গ, সেখানে কয়েক বছর ধরেই অভিবাসনবিরোধী, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে ক্রমাগত ভালো করছে। ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেনের মতো দেশগুলোতে এসব দল প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। অনেক দেশে তারা ক্ষমতার কাছাকাছিও পৌঁছে গেছে।

কিন্তু ইতালিতে ব্রাদার্স অব ইতালি ও এর মিত্ররা বিপুল জয় পাওয়ার পর ইউরোপে ডানপন্থিদের উত্থান আরও স্পষ্টভাবে সবার চোখে ধরা পড়েছে। অনেকের মতে, ইউরোপের রাজনীতিতে অবধারিতভাবে বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে।

ইতালিতে উগ্র ডানপন্থিদের জয়জয়কার কেন?
রোমের লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিক অধ্যাপক ড. রবার্তো দা’লিমন্ত বলছেন, ইতালির মানুষজন মূলত পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। তবে অভিবাসন-বিরোধিতাই এর একমাত্র কারণ নয়।

তিনি বলেন, জর্জিয়া মেলোনির দল ব্রাদার্স অব ইতালি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিরোধীদলে ছিল। তবে এবার ইতালির অনেক ভোটার একটা পরিবর্তন আনতে ভোট দিয়েছে। মেলোনি অভিবাসন ঠেকানো, ট্যাক্স কমানো, ইতালির আত্মপরিচয় তুলে ধরা, ব্রাসেলসে ইতালির জাতীয় স্বার্থরক্ষার মতো যেসব নীতির কথা বলেছেন, সেগুলো লোকে পছন্দ করেছে। তাছাড়া মেলোনি নতুন ও ভিন্ন ধরনের একজন রাজনীতিক। তিনি আগে কখনো সরকারে ছিলেন না এবং পূর্বসূরীদের চেয়ে ভালো করবেন- লোকে এটাই ধরে নিয়েছে। তার বিজয়ের কারণ এগুলোই। মূল কথা হচ্ছে, লোকে একটা পরিবর্তন চেয়েছে।

শুধু ইতালি নয়, প্রকৃতপক্ষে গোটা ইউরোপেই ডানপন্থি দলগুলো অনেকদিন ধরে শক্তিশালী হচ্ছিল। ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট, জার্মানিতে এএফডি, হাঙ্গেরিতে ফিডেস, সুইডেনে এসডি, স্পেনে ভক্স পার্টি, অস্ট্রিয়ায় ফ্রিডম পার্টি, ইতালিতে লিগ এবং ব্রাদার্স অব ইতালি- এদের তালিকা মোটেও ছোট নয়।

একেক দেশে একেক নামের দল হলেও এদের কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। এরা সবাই কমবেশি জাতীয়তাবাদী, অভিবাসন-বিরোধী, বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসন-বিরোধী এবং তাদের এ বিরোধিতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলামবিদ্বেষী চেহারা নেয়।

ইউরোপে ডানপন্থিদের জনপ্রিয়তা কেন বাড়ছে?
ফ্রান্সের সাবেক সংসদ সদ্য ও রাজনীতিবিদ পিয়ের লেকিয়ার মতে, এর একাধিক কারণ রয়েছে।

তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবেই এর কোনো একক কারণ নেই। আসলে অনেক মানুষই ইউরোপকে পুরোপুরি বোঝে না। এর কারণ ইউরোপের ভেতরেই রয়েছে। যেমন- ফ্রান্সে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কারের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল সরকার, যা পূরণ হয়নি। মানুষ গরিব হচ্ছে, হাতে যথেষ্ট অর্থ নেই। জাতীয়তাবাদী দলগুলো এ পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে। তারা অভিবাসনকে এর জন্য দায়ী করছে। কিন্তু আসলে কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে, যেগুলো ফরাসিরা করতে চায় না। সেই চাকরিগুলো অভিবাসীরা নিয়ে নিচ্ছে। জাতীয়তাবাদীরা বলছে, অভিবাসী বেড়ে গেছে, তারাই ফ্রান্সে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে। কিন্তু এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।

লেকিয়ার ভাষ্যমতে, যদি ফ্রান্সের কথা বলি, ইইউ এবং অভিবাসন প্রশ্নে মারিন লা পেন আগে যে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। একসময় তিনি তীব্র ইইউ-বিরোধী ছিলেন। কিন্তু সবশেষ নির্বাচনের সময় দেখা গেলো, ইইউ এবং অভিবাসন প্রশ্নে তার অবস্থান অনেক নরম হয়েছে। আসলে তাদের প্রভাব কখনো বাড়ে, কখনো কমে। জার্মানিতে একসময় উগ্র ডানপন্থি দলগুলো ভালো করছিল। কিন্তু এখন তাদের জনপ্রিয়তা আবার কমে যাচ্ছে।

এক হিসাবে দেখা যায়, ইউরোপের অন্তত ১৯টি দেশে এখন ডানপন্থি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল সক্রিয়। তার মধ্যে অন্তত ১৪টি দেশের নির্বাচনে এসব দল ১০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে সুইডেনের নির্বাচনে অভিবাসন-বিরোধী উগ্র ডানপন্থি দল এসডি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে কিংমেকারের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে।

সুইডেন এবং ইউরোপের সামপ্রতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে দুটি বই লিখেছেন লেখক ফ্রেডরিক সেগারফেল্ড। তিনি মনে করেন, শুধু ইউরোপে নয়, সারা বিশ্বেই ডানপন্থি রাজনীতি শক্তিশালী হচ্ছে।

সেগারফেল্ড বলেন, আমার মনে হয়, এটি এক বৃহত্তর প্রক্রিয়ার অংশ। মানুষ একধরনের শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব চাইছে। এটি শুধু ইউরোপে ঘটছে তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা, ব্রাজিল- এগুলো কয়েকটা উদাহরণ মাত্র। এটা সারা পৃথিবীতেই একটি প্রধান ধারা হয়ে উঠেছে। দেশে দেশে এর চেহারা ভিন্ন। তবে সাধারণভাবে তারা প্রগতিশীলতার বিরোধী। এরা বলছে, শহুরে আর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্ব›দ্ব তৈরি হচ্ছে, পরিবর্তনের গতি খুব বেশি দ্রæত হয়ে গেছে, দেশের সঙ্গে একাত্মতাবোধ কমে যাচ্ছে। যেমন- সুইডেনে এখন জনসংখ্যার ২০ শতাংশেরই জন্ম হয়েছে ভিনদেশে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এটি ঘটে গেছে।

তার কথায়, আসলে সুইডেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আগে থেকেই অ্যাসাইলামের মাধ্যমে অভিবাসনের বিরোধী ছিল। কিন্তু এটি রাজনৈতিক এজেন্ডার শীর্ষে ছিল না। এর মধ্যে অপরাধ-সহিংসতা বেড়ে গেছে এবং লোকে এটিকে অভিবাসনের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে।

বিশেষ করে, ২০১৫ সালে সিরিয়া থেকে আসা প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্ব›দ্ব তীব্র হতে থাকে। ডানপন্থি দলগুলোর চোখে এই ঘটনা অভিবাসন-বিতর্ককে ভিন্ন এক মাত্রা দেয়।

ফ্রেডরিক সেগারফেল্ড বলেন, এর একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামবিদ্বেষ। উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে মুসলিমদের দেখা হচ্ছে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের বিপরীত হিসেবে এবং ইউরোপের বিভিন্ন অংশেই এখন মুসলিমবিরোধী সেন্টিমেন্ট কাজ করছে। আবার, এখানে ড্যানিশ-সুইডিশ এক রাজনীতিবিদ কোরআন পোড়ানোর মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। ফলে এ বিতর্ক চলছে যে, কীভাবে আমরা অভিবাসন-বিরোধিতা বা ইসলামবিদ্বেষের মতো উসকানির মুখে এই সমাজকে রক্ষা করতে পারি।

তার কথায়, সুইডেনে কখনোই ফ্যাসিস্ট বা নাৎসিরা ক্ষমতায় ছিল না। কিন্তু ইতালিতে নিও-ফ্যাসিজম কখনোই পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। এখন ইউরোপের অনেক দেশেই ডানপন্থি দলগুলোর অস্তিত্ব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে যাচ্ছে। এরা আগে চরমপন্থি ছিল। কিন্তু এখন মধ্য-ডানপন্থি অবস্থান নিয়ে রাজনীতির মূলধারায় জায়গা করে নিতে চেষ্টা করছে এবং তাতে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতাও পাচ্ছে। এরা গণতন্ত্রের জন্য ততটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়, তার চেয়ে বরং উদারপন্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ইতিহাসে আমরা এখন সবচেয়ে অ্যান্টি-লিবারেল সময় পার করছি।

ইউরোপে ডানপন্থার এই উত্থান খুব শিগগির থামবে বলে মনে করেন না সেগারফেল্ড। তার কথায়, আমার মনে হয় এটি বেশ কিছু দিন চলবে। আমাদের উদারপন্থা, সহিষ্ণুতা এবং খোলা-দুয়ার নীতিকে রক্ষা করতে হবে। ডানপন্থি দলগুলোর উত্থানের এই ধারার অবসান ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু আমরা সেটি পারবো কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই। কারণ পুরো ইউরোপজুড়েই এটি একটি শক্তিশালী ধারায় পরিণত হয়েছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে এর ফলে হুমকির মুখে পড়বে, আমার তা মনে হয় না।

অধ্যাপক রবার্তো দা’লিমন্তের মতে, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এমনটা হয়েই থাকে এবং উগ্র ডানপন্থিদের এই উত্থানও হয়তো সাময়িক ব্যাপার।

তিনি বলেন, আমরা এত অবাক হচ্ছি কেন? এটি গণতন্ত্র। মানুষ মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, অভিবাসন- এসব নিয়ে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। তারা সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা চায়। বামপন্থি দলগুলো এসব মানুষের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। সেজন্যই তারা ডানপন্থিদের দিকে মুখ ফিরিয়েছে। এখানে হতাশ হলে তারা হয়তো আবার বামপন্থিদের দিকে তাকাবে। মানুষের সমর্থন পেন্ডুলামের মতো একবার এদিকে একবার ওদিকে যাবে। গণতন্ত্রে এটি খুবই স্বাভাবিক।

স্ব.বা/রু

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *