মেট্রো স্টেশন ঘিরে নতুন বাড়ি নির্মাণ, বেড়েছে ভাড়া

জাতীয় লীড

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: মিরপুরের কাজীপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় পরিবারসহ থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী হাবিবুর রহমান। সেখানে ১৪ হাজার টাকা বাসা ভাড়ার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে বাড়িওয়ালাকে দিতে হয় প্রায় ১৬ হাজার টাকা। এতে তার বেতনের সিংহভাগই বাসা ভাড়া পরিশোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।

এ অবস্থায় কিছুটা কম টাকায় বাসা ভাড়া পাওয়ার আশায় তিনি এসেছেন উত্তরা এভিনিউ ৯ নম্বর এলাকায়। মেট্রোরেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় বাসা নিতে চান তিনি। কেননা সেখানে থেকেই মেট্রোরেলে চড়ে অফিস করতে চান হাবিবুর রহমান। তবে এ এলাকায় বাসা খুঁজতে এসে আশাহত হয়েছেন তিনি। আগের মতো কম ভাড়ায় এ এলাকায় আর বাসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

হাবিবুর রহমান  বলেন, আমার অফিস কারওয়ান বাজারে, আর বাসা কাজীপাড়ায়। তবে বাসাটা পরিবর্তন করতে চাই। উত্তরায় বাসা ভাড়া কিছুটা কমে পাব, আর মেট্রোরেলে চড়ে অফিসে যাওয়া যাবে—এমন ভাবনা থেকে মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় বাসা খুঁজতে এসেছিলাম। তবে এ এলাকায় ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। ঘুরে দেখলাম শত শত ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। এ ভবনগুলো নির্মাণ হয়ে গেলে আরও অনেক মানুষ এদিকে চলে আসবে। বাসা ভাড়াও বেড়ে যাবে অনেক।

তিনি বলেন, বর্তমানে কাজীপাড়ায় যে ধরনের বাসায় থাকি, সেই মানের বাসার ভাড়া এখানে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। আমি ভেবেছিলাম এদিকে আরও অনেক কম টাকায় বাসা ভাড়া পাব। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল।

মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন সংলগ্ন এভিনিউ ৯ এ একটি বাসায় টু-লেট দেখে কথা হলো বাসাটির কেয়ারটেকার মালেক মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, এই বাসাটি একদম মেট্রোরেলের স্টেশনের পাশেই। তাই এটার ভাড়া একটু বেশি। তিন রুমের বড় এই বাসার ভাড়া ২৫ হাজার টাকা। আর আশআশে দুই রুমের বাসা প্রায় ১৪/১৫ হাজার টাকা ভাড়া পড়বে।

তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও আশপাশের সব এলাকায় অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা ছিল। বাসা মালিকরা ভাড়াটিয়া খুঁজে পাচ্ছিল না। তবে নতুন বছরের প্রথম মাস থেকে এই এলাকায় প্রচুর ভাড়াটিয়া উঠছে। প্রতিদিনই বাসা খুঁজতে মানুষ আসছে। তাই ভাড়াও আগের চেয়ে বাড়িয়েছেন বাসা মালিকরা।

সপ্রতি দিয়াবাড়ী, সোনারগাঁও জনপথ, উত্তরা সেক্টর ১৫, মেট্রোরেল চত্বর, উত্তরা মডেল টাউন, সেক্টর ১৫, এভিনিউ ৯ নম্বর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শত শত নতুন বাড়ি নির্মাণের কাজ চলছে। প্রায় সব অলি-গলিতেই দেখা গেছে এমন চিত্র। বলতে গেলে সবগুলোই সুউচ্চ ভবন। রাত দিন কাজ চলছে নির্মাণাধীন এসব ভবনের। আর যেসব ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে, সেগুলোতে প্রতিদিনই বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য আসছেন অনেকেই।

দিয়াবাড়ী এলাকায় মেট্রোরেল ডিপোর কাছাকাছি নির্মাণ হচ্ছে ৮ তলার একটি বাণিজ্যিক ভবন। যেখানে শুধু অফিস, ব্যাংক ও বিমার জন্য ভাড়া দেওয়া হবে। এই বিল্ডিংয়ে নির্মাণ কাজ তদারকিতে দায়িত্বে থাকা জাকির হোসেন বলেন, মেট্রোরেলের স্টেশন ঘিরে এই এলাকায় প্রচুর মানুষের বসবাস হবে। সে কারণে তিন মালিক মিলে এই বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কাজ করছে। এই বিল্ডিংয়ের মতো আশপাশে প্রায় শতাধিক বাসা নির্মাণের কাজ চলছে। আমাদের ভবনের কাজ এখনো শেষ হয়নি। তবুও প্রতিদিন ফ্লোর ও অফিস ভাড়া নেওয়ার জন্য লোকজন আসছে। তারা খোঁজ-খবর নিচ্ছে, ভাড়া জানছে ও বুকিং দিতে চাচ্ছে।

দিয়াবাড়ী বটতলা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চায়ের দোকান পরিচালনা করেন মনছুর আহমেদ। প্রবীণ এই চা দোকানি বলেন, মেট্রোরেল হওয়ার পর এই এলাকায় সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। প্রতিদিন অনেক মানুষ এসে বাসা খুঁজছে। কয়েকমাস আগেও এই এলাকায় মানুষ থাকতে চাইতো না। কারণ তখন যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ছিল না। এখন মেট্রোরেলের কারণে সবকিছু বদলে গেছে।

মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে একটি ৬ তলা বাড়ির নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে। তিনজন মিলে বাড়িটি নির্মাণ করছেন। তাদের মধ্যে একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আসলে মেট্রোরেল হওয়ার পর এদিকে আর কোনো জমি বিক্রি হচ্ছে না। সবাই ভাবছে এর দাম আরও অনেক বাড়বে। মূলত আগেই যারা জায়গা কিনেছে তারাই এখন বাড়ি নির্মাণের কাজ করছে। মেট্রোরেলের কারণে যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হওয়ায় সবাই এদিকে এসে থাকতে চাচ্ছে। তাই এ অবস্থায় আমরা ঋণ নিয়ে দ্রæত বাড়ির কাজ করছি।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে দিয়াবাড়ী, উত্তরা ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ নম্বর সেক্টর, সোনারগাঁও জনপথ, মেট্রোরেল চত্বর, উত্তরা মডেল টাউন, সেক্টর ১৫, এভিনিউ ৯ নম্বর, পঞ্চবটি, উত্তরা পশ্চিম এভিনিউ ও বিরুলিয়া এলাকায় নতুন আবাসন প্রকল্পের কাজ শুরু করেছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং প্রতিষ্ঠান।

দিয়াবাড়ী বটতলা এলাকায় একটি পাঁচতলা বাড়ির মালিক সাজ্জাদুল ইসলাম মুকুল। তিনি বলেন, এতদিন পর্যন্ত খুব একটা ভাড়াটিয়া পেত না এই এলাকার বাড়ির মালিকরা। তবে মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর এই এলাকার রূপ ও চাহিদা বদলে গেছে। আগে আমার বাসার তিন-চারটা ফ্ল্যাট ফাঁকা ছিল। এখন ফেব্রুয়ারি থেকে সেগুলো ভাড়া হয়ে গেছে। আগে এই এলাকার বাসা ভাড়া ছিল ১০ হাজার টাকা। এখন সেগুলো হয়েছে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা।

সার্বিক বিষয় নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মাদ খান বলেন, মিরপুর থেকে দিয়াবাড়ীর দিকে মধ্যবিত্ত, নিন্ম, নিন্ম-মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকদের সংখ্যা বেশি। এখন এখানে যখন বড় ধরনের ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে, তখন এখানে সেসব মানুষকে সরে যেতে হচ্ছে। কারণ সেখানে বড় বড় কোম্পানি, ক্ষমতাধররা ঢুকে যাচ্ছে। এতে করে জমির দাম বাড়ছে, জীবনযাতার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে এসব এলাকার বাসা ভাড়া বাড়ছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। তবে সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে মেট্রোরেল স্টেশনকেন্দ্রীক আবাসন, বাণিজ্যিক ভবন নিয়ে সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

স্ব.বা/বা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *