৭১-এর যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘গাদ্দার’ উপাধী পেলেন সাংবাদিক

জাতীয়

স্বদেশবাণী ডেস্ক: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কয়েকজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে  ১০ দিনের সফরে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পাঠিয়েছিল ইয়াহিয়া-ভুট্টো সরকার।

পাক হানাদার বাহিনীদের হাতে নৃশংসতা চলাকালীন সেনা তত্ত্বাবধানে ঢাকা ও কুমিল্লার বেশ কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখেন এসব সাংবাদিক।

দশ দিনে গণহত্যার নিকৃষ্ট উদাহরণের চাক্ষুস সাক্ষী হন তারা সবাই।

সফর শেষে তাদেরকে যখন বলা হয় ‘অ্যাসানমেন্ট’ অনুযায়ী প্রতিবেদন লিখতে তখন কেবল একজন পাক-সাংবাদিকের বিবেক নাড়া দিয়ে উঠেছিল।
তার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল নিরিহ মানুষদের আর্তনাদের চিৎকারে। তার মনে হয়েছিল, বাংলাদেশে দেখে যাওয়া প্রকৃত পরিস্থিতি প্রকাশ করতে না পারলে সারা জীবন গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে তাকে।

তিনি প্রতিবেদন লিখলেন। তবে ইয়াহিয়া-ভুট্টো সরকারের পুতুল হয়ে নয়। তার প্রতিবেদনে প্রকাশ পেল বাংলাদেশে পাক হানাদারদের হত্যা ও ধর্ষণের পৈশাচিক চিত্র।

এমন প্রতিবেদন লেখার আগে অবশ্য সপরিবারে লন্ডনে পালিয়ে যান ওই সাংবাদিক। সেখানে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও বর্বরতা ফাঁস করে দেন।

১৯৭১ সালের ১৩ জুন যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমস পত্রিকায় সম্পাদকীয় পাতার দুই পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হয় সেই প্রতিবেদন। প্রতিবেদনের শিরোনাম দেওয়া হয় কেবল একটিমাত্র শব্দ – জেনোসাইড।

ওই এক শব্দের শিরোনামেই প্রথমবারের মতো ফাঁস হয় মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার ব্যাপকতা।

পাকিস্তানি হয়েও পাকবিরোধী প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিশ্বদুয়ারে সত্য তুলে ধরা সেই পাকিস্তানি সাংবাদিকের নাম নেভিলে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ।

ভারতের গোয়ায় জন্মগ্রহণ করলেও পড়াশোনা ও যৌবনের বড় একটি অংশ পাকিস্তানের করাচিতে কাটান এই সাংবাদিক।

তৎকালীন পূর্ব-বাংলা নিয়ে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে আজ অবধি পাকিস্তানে গাদ্দার বা বিশ্বাসঘাতক বলা হয় এই মহান মানুষটিকে। তবে তার ওই প্রতিবেদনকে পরবর্তীতে গত অর্ধ শতাব্দির মধ্যে দক্ষিণ এশীয় সাংবাদিকতার সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিবেদন বলা হয়।

কারণ ওই প্রতিবেদনের পরই ৭১ সালে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানের গণহত্যার সত্যতা নিশ্চিত হয় এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে ওঠে। এরপর ভারতকে মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহ যোগায় প্রতিবেদনটি।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মাসকারেনহাস ও তার সেই প্রতিবেদন  নিয়ে ২০১১ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে শিরোনাম করা হয় – ‘বাংলাদেশ যুদ্ধ: যে প্রতিবেদন ইতিহাস বদলে দিয়েছিল।’

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমসকে বলেছিলেন, প্রতিবেদনটি তাকে এতটাই হতবাক করে দেয় যে তিনি ভারতের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের ভিত্তি তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে ইউরোপীয় দেশগুলোর রাজধানী ও মস্কোতে ব্যক্তিগত কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন।

জীবন বাজি রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এমন প্রতিবেদন লেখার বিষয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস পরবর্তীতে তার ‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পূর্ব বাংলায় আমি যা দেখেছি, হিটলার বা নাৎসিদের অমানবিক অত্যাচারের কথা যা পড়েছি, তার চেয়েও ভয়াবহ মনে হয়েছে। আর সেই অত্যাচার আমার দেশের সেনারা করছে। পূর্ব বাংলার ওপর চলা এই নির্যাতনের কথা আমাকে বিশ্ববাসীর কাছে বলতেই হতো। তা না হলে সারা জীবন নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হতো। আমার সহকর্মীরা অস্বীকার করেছিল। আমি তখন ভেবেছিলাম, যা দেখেছি সেটা যদি লিখতে না পারি তাহলে আর কখনওই অন্য কোনও কিছু লিখতে পারব না।’

সে সময় পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে ওই প্রতিবেদনকে বড় আকারের বিশ্বাসঘাতকতা আখ্যা দেওয়া হয়। তাকে শত্রুদের এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনকে একে ভারতীয় প্রচারণা বলে দাবি করে।

এদিকে বাংলাদেশে এখনও এই সাংবাদিককে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তার প্রতিবেদন এখনও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদর্শন করা হয়।

১৯৮৬ সালে লন্ডনে মারা যান মাসকারেনহাস নামের এই পাকিস্তানি সাংবাদিক।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *