বাঘা-চারঘাটে নিষেধ ভেঙে ইলিশ নিধনের উৎসব পদ্মায়

রাজশাহী লীড

আব্দুল হামিদ মিঞা,বাঘা:
আজ বিক্রি হইছে হাজার টেহা। কাল হইছিলো ৬’শ টেহা। মাছ পাইলেও নৌকা প্রতি ৩’শ টেহা দেয়্যান লাগবো না পাইলেও ওই টেহা দেয়্যান লাগবো। স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর জিজ্ঞাসাবাদে চরের ভাষায় মাছ ধরে বিক্রি করার এ গল্প করছিলেন পদ্মার তীরবর্তী চকরাজাপুর এলাকার এক জেলে। আড়াল থেকে কথাগুলো শোনার পর,কাছে গিয়ে নাম পরিচয় জানার আগেই সাংবাদিক পরিচয় জেনে শটকে পড়েন তিনি। ওই বাজারে চায়ের দোকানে বসে,নিষেধাজ্ঞার মধ্যে মাছ ধরে বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে আরেক জেলে বলেন, অন্য সময় এখানকার পদ্মায় ইলিশ মাছ পাওয়োন যায়না। সুযোগ বুইঝা সবকিছু করবার লাগে। বহুত জনেই পদ্মায় ডিমওয়ালা মা ইলিশ আর জাটকা ধরে বিক্রি করতাছে। আমাগো জায়গা জমিন যা ছিল,নদীতে ভাইঙা গেছে,মাছ না ধরে করুম কি।

মৎস্য অধিদপ্তরের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রজনন মৌসুমে পদ্মা নদীতে এভাবেই চলছে ইলিশ নিধনের মহাউৎসব। আর জেলেদের ধরা ইলিশ নিয়ে ব্যস্ত ক্রেতা- বিক্রেতারা। এই ইলিশ ক্রয়-বিক্রয়কে কেন্দ্র করে সরগরম হয়ে উঠেছে চারঘাট-বাঘার পদ্মার তীরবর্তী এলাকা।
বাঘা-চারঘাটে প্রায় ২০টি গ্রুপ,বাঘা উপজেলার কালিদাশখালি,চকরাজাপুর, দিয়াড়কাদিরপুর, চৌমাদিয়া, আতারপাড়া, আলাইপুর, কিশোরপুর, মীরগঞ্জ ও চারঘাটের পিরোজপুর, ইউসুফপুর, সাহাপুর, চন্দনশহরসহ মুক্তারপুর এলাকায় মা ইলিশ ধরে বিক্রি করে। দিনের চেয়ে রাতে ইলিশ শিকার হয় বেশি। বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে এক দফা নদীতে জাল ফেলে সন্ধ্যায় জাল তুলে মাছ নিয়ে আসে নদীর তীরে। রাতে আরেক দফা নদীতে জাল ফেলে সকালে মাছ নিয়ে তীরে এসে, নৌকা থেকে নামিয়ে নদী তীরের ঝোপ-জঙ্গলে, কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছাড়াও মজুদ করা হয় বিভিন্ন বাড়িতে। মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল কিংবা অটোরিকশায় গিয়ে এসব মাছ কিনছেন ক্রেতারা ।

মঙ্গলবার (১৬-১০-১৮) সকাল ৮টায় সরেজমিন দেখা গেছে,পদ্মা থেকে ইলিশ শিকার করে আসা ট্রলারগুলো সারিবদ্ধভাবে কালিদাশখালি মৌজায় চকরাজাপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে নোঙর করে আছে। নোঙর করা প্রতিটি ট্রলারের খন্দ (ট্রলারে মাছ সংরক্ষণ করার বাক্স) থেকে দু’তিন জন জেলে শিকার করা ইলিশ মাছ বের করে দিচ্ছেন। অন্য জেলেরা এই মাছ থেকে ছোট ও বড় ইলিশ পৃথক করে ঝুড়িতে তুলে দিচ্ছেন। এসব ঝুড়ি মাথায় করে গোপন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। আলাইপুর ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, নদী পাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমের দিকে পদ্মা নদীতে মা ইলিশ শিকার করছে জেলেরা। অনেক ক্রেতাই ঘাট থেকে এসব ইলিশ কিনে বাড়িতে নিয়ে যান। মৎস্য অধিদপ্তরের অভিযানে জাল ও জেলেসহ নৌকা আটক করলেও থেমে নেই ইলিশ ধরার উৎসব। অভিযান পরিচালনার আগেই খবর পৌঁছে যায় জেলেদের কাছে।

নিষিদ্ধ এ সময়ে ইলিশ ধরা,পরিবহন, মজুদ ও বিক্রি বন্ধে যারা কাজ করবে, তাদের সহযোগিতায়ই নদীতে অবাধে মা ইলিশ শিকার করছে জেলেরা। স্থানীয় এক ব্যক্তির মন্তব্য, ‘এই হলো ইলিশ রক্ষার নমুনা। তাদের সঙ্গে কারা আছেন-এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও বোঝা গেল, বিষয়টি জানাজানি হলে নিষেধাজ্ঞা চলে যাওয়ার পর ওই লোকদের ওপর অত্যাচার করা হতে পারে। এ কারণে স্থানীয়রা তাদের নাম জানলেও বলতে রাজি হননি কেউ।

রহমান খান নামের এক জেলে জানান,সারা বছর এই কাজ করেই তারা সংসার পরিচালনা করেন। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করান এ কাজ করেই। সাহাবাজ নামের আরেকজন জানান,এলাকার বেশিরভাগ জেলে প্রতিদিনের রোজগার দিয়েই তাদের সংসার পরিচালানা করেন। মাছ সরবরাহ ভালো থাকলে তাদের আয়ও ভাল হয়। মাছ না ধরলে পরিবার পরিজন নিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাতেই হিমশিম খেতে হয়। তারা জানান, নিষিদ্ধ সময়ে মাত্র ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘হাট-বাজারে কোথাও ইলিশ বিক্রি হয় না। তবে চুরি করে কিছু জেলে মাছ ধরে বিক্রি করছে, এটা সত্য। অভিযান চালিয়ে ৭ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ৬৫ কেজি মাছ, ৪৫ হাজার ৭’শ মিটার জাল ও ১টি নৌকা আটক করেছেন।

চারঘাটের মৎস্য অফিসার সেলিম আকতার বলেন, সাধ্য মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। জলসীমা অনেক বেশি হওয়ার পরও কমসংখ্যক জেলে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ শিকারে নেমেছে। যা গত বছরের তুলনায় অনেক কম। অভিযান চালিয়ে ৬৬ হাজার ২০ মিটার জাল ও ১৭ কেজি ইলিশ মাছ জব্দ কেেছন। নিষিদ্ধ সময় পর্যন্ত অভিযান অব্যবাহত থাকবে বলে জানান দুই মৎস্য অফিসার।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *