তানোরে আদালতের দোহায়ে আবারো সেচ মটরে বিদ্যুৎ সংযোগ! প্রায় ৫ কোটি টাকা বানিজ্য 

রাজশাহী
সারোয়ার হোসেন, তানোর(রাজশাহী): উচ্চ আদালতের রিট পিটিশন বা আদেশের দোহায় দিয়ে রাজশাহীর তানোরে আবারো গভীর অগভীর নলকূপে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে মরিয়া হয়ে পড়েছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তানোর জোনের অসাধু কর্মকর্তারা বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোববার সকালের দিকে উপজেলার সরনজাই ইউনিয়ন ইউপির এগ্রো ওয়ানের মালিক সাজেদুর রহমান(মারকনী) বাদি হয়ে একই ইউপির তাতিহাটি গ্রামের রেজাউল ইসলাম কে বিবাদী করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইউএনও বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। এর অনুলিপি দেয়া হয় বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তানোর জনেও। এর আগে প্রায় ৪৫ টির মত গভীর অগভীর সেচ নলকূপে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রত্যায়ন পত্র দেয়া হয়। প্রায় ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে এসব সংযোগ ও অনুমোদন এবং প্রত্যায়ন দেয় তৎকালীন ইউএনও বিল্লাল হোসেন, বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এজিএম কামাল হোসেন  এবং উপজেলা পরিষদের স্টেনো তোফিক বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেন। অথচ বিগত ২০১৩-১৪ সালে ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় সকল ধরনের সেচ মটার দেয়া নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু এচার কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে সব নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেচ কমিটির অনুমোদন ছাড়াই এসব গভীর অগভীর নলকূপে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছেন। ফলে এচার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলেছেন কৃষকরা।
সাজেদুর রহমান অভিযোগে উল্লেখ করেন, বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময় নেয়া হয় প্রকল্প টি। কোন নিয়মের তোয়াক্কা না পূর্বের গভীর নলকূপের কমান্ড এরিয়ার মধ্যে STW মটার স্থাপন করা হয় যা সম্পূর্ণ রুপে অবৈধ। এই মটারে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হলে কৃষক দের মাঝে মারপিট শুরু হবে। কোনভাবেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া যাবে না। তারা দলীয় পরিচয়ে এধরণের অমানবিক কাজ করেছেন। কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই শুধু অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে এধরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যা বরেন্দ্র অঞ্চল জন্য চরম হুমকি।
সাজেদুর রহমান বলেন, স্বৈরাচার সরকারের সময় নেয়া এসব প্রকল্প জরুরি ভিত্তিতে বাতিল করতে হবে। কারন এসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে। পানির লেয়ার রক্ষা করতে হলে এধরনের মটরে কোন ভাবেই যেন বিদ্যুৎ সংযোগ না দেয়। আমি জেলা ও উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছি সংযোগ না দিতে। তারা আমাকে বলেছে লিখিত অভিযোগ দেন সংযোগ দেয়া হবে না। তারপরও যদি সংযোগ দেয়া হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাসহ নানা কর্মসূচি দেয়া হবে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তানোর জোনের ডিজিএম জহুরুল ইসলাম বলেন, তার মটারে কোনভাবেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া  হবেনা। আপনি নাকি আদালতের আদেশে দিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি জানান অভিযোগ হয়েছে সংযোগ হবে না।
জানা গেছে,  উপজেলায় প্রায় ৫ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে অন্তত ৪৫টি গভীর-অগভীর নলকূপে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে । ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামতে থাকায় বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন করে কোনো গভীর নলকূপ না বসানোর সরকারি নির্দেশনা আছে। তবে সে নির্দেশনা অমান্য করেই এসব নলকূপে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এই গুরুতর অনিয়ম করেছেন দুই কর্মকর্তা ও এক কর্মচারী ।
জানা যায়, উপজেলায় গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করতে হলে উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন লাগে। গভীর নলকূপের অনুমোদন দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে সেচ কমিটি সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়। সেচ কমিটির ছাড়পত্র পেলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ওই সব নলকূপের জন্য বিদ্যুৎ-সংযোগ দেয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সেচ কমিটির আহ্বায়ক। আর সদস্যসচিব হলেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) স্থানীয় কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী।  সেচ কমিটির সভার কার্যবিবরণী গায়েব করে দেন তানোর থেকে সদ্য বদলি হওয়া বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। এরপর প্রায় ৪৫টি গভীর ও অগভীর নলকূপকে সভায় অনুমোদন দেওয়ার তথ্য দিয়ে তিনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে ছাড়পত্র দিয়েছেন। বাস্তবে গত বছরের শেষ দিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন সাতটি গভীর-অগভীর নলকূপকে অনুমোদন দিয়েছিল সেচ কমিটি।
সে সময় সেচ কমিটির সভাপতি ছিলেন তানোরের ইউএনও বিল্লাল হোসেন। বর্তমানে কিশোরগঞ্জে কর্মরত বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আমি বড়জোর সাতটি গভীর-অগভীর নলকূপের অনুমোদন দিয়েছিলাম। এখন যদি ৪৫টিতে সংযোগ দেওয়া হয়, তাহলে সেটা অবৈধ। এ রকম হওয়ার সুযোগ নেই। কীভাবে হলো তদন্ত করা দরকার।তানোরের বর্তমান ইউএনও ও সেচ কমিটির আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আগের ইউএনও আসলেই কতটি গভীর-অগভীর নলকূপকে অনুমোদন দিয়েছিলেন, তা জানতে পারিনি। কারণ, কার্যবিবরণী খাতা থাকত কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের কাছে। খাতার জন্য আমি কামরুজ্জামানকে কয়েক দফা ফোন করেছি। তিনি আমার ফোন ধরেননি।’
ইউএনও আরও বলেন, ‘পর পর দুটি মিটিংয়ে এ বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। প্রথম মিটিংয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তানোর কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক জহুরুল ইসলাম ছিলেন। পরের সভায় তাঁকে কাগজপত্রসহ আসতে বলেছিলাম। সে সভায় তিনি আসেননি, প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কাগজপত্র দেননি। সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হলে বিএমডিএ কিংবা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নিতে পারি না। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখতে পারি। সেটা লিখব।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন ছাড়াই তানোরে একের পর এক ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর-অগভীর নলকূপে সংযোগ দেওয়ার বিষয়টি উপজেলার সবশেষ দুটি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচিত হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পক্ষ থেকে সভায় জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে মোট ৪৫টি গভীর-অগভীর নলকূপে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নতুন ৩৫টি। বাকিগুলো নবায়ন ও সংযোগের শ্রেণি রূপান্তর করা।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে তানোরের ইউএনও বিল্লাল হোসেন বদলি হয়ে চলে যাওয়ার পর সেচ কমিটির কার্যবিবরণী খাতা গায়েব করে দেন সদস্যসচিব ও বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। বিভিন্ন মৌজায় নতুন গভীর-অগভীর নলকূপ বসানোর অনুমোদন সেচ কমিটির আছে জানিয়ে তিনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে ছাড়পত্র দেন। যেসব মাঠে বিএমডিএর গভীর নলকূপ আছে তার ৩ হাজার ফুট এলাকার মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর বা অগভীর নলকূপ অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অনুমোদনহীন এসব নলকূপের অনুমোদনের ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও মাথায় রাখেননি সহকারী প্রকৌশলী।
সেচ কমিটির সদস্যসচিব প্রতিটি গভীর নলকূপের জন্য ১৫ লাখ এবং অগভীর নলকূপের জন্য ১০ লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব নলকূপের জন্য ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে এভাবে প্রায় ৫  কোটি টাকা টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, উপজেলা পরিষদের স্টেনো টাইপিস্ট তৌফিকুল ইসলাম এসব সমন্বয় করেছেন, আর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তানোর কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক কামাল হোসেন ঘুষের টাকার ভাগ পেয়েছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে সম্প্রতি সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ কামরুজ্জামানকে পাবনায় শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে।
বিষয়টি স্বীকার করে বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘তার ব্যাপারে বিভিন্ন অভিযোগ আসার কারণে পাবনায় বদলি করা হয়েছে। অভিযোগগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। অভ্যন্তরীণ তদন্তও চলছে। তদন্ত শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে রোববার কামরুজ্জামানকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তানোর কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক কামাল হোসেনকেও ফোন করা হয়। অভিযোগের বিষয় জানালে তিনি বলেন আমি এসব দেয়ার মালিক। সেচ কমিটি ছাড়পত্র দিয়েছেন আমরা কাজ করেছি। তারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বললে করা হবে। তিনি আরো বলেন, সাতটিতে সংযোগ দেয়া হয়েছিল না। তারা উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। তার প্রেক্ষিতে আদালত আদেশ দেয়। এজন্য সাতটিতে সংযোগ দেয়া হয়েছে। তবে আদলতে আদেশ গত ১৩ আগস্ট মেয়াদ শেষ হয়েছে। তাহলে কিভাবে সংযোগ দেন প্রশ্ন করা হলে উত্তরে বলেন আদালতের আদেশ মানতে বাধ্য। স্টেনো টাইপিস্ট তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলার মিটিংয়ে আলোচনার দিনই আমি বিষয়টি প্রথম শুনেছি। তার আগে কিছুই জানতাম না। তাই আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নাই । পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তানোর জোনের এজিএম কামাল হোসেন ও স্টেনো তৌফিক পরস্পর আত্মীয়।
Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *