স্বদেশ বাণী ডেস্ক: পানি কিংবা কোমলপানীয় পানের পর প্লাস্টিকের (পিইটি) বোতলটি সাধারণত ফেলেই দিই আমরা। সেই ফেলে দেয়া জিনিস দিয়েই এবার পরিবেশবান্ধব বোতলবাড়ি তৈরি করেছেন কুমিল্লার হোমনা উপজেলার সীমান্তবর্তী লটিয়া গ্রামের মো. শফিকুল ইসলাম।
তিনি উপজেলার লটিয়া গ্রামের মোহাম্মদ আলী মোল্লার ছেলে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মো. শফিকুল আনসার সদস্য হিসেবে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশলাইনে কর্মরত আছেন।
তিনি প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত বোতল দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এলাকার মানুষকে। এই ব্যতিক্রম বাড়িটি দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন তার বাড়িতে। মানুষের পদভারে গ্রামটি এখন মিনি পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
সরেজমিন হোমনা পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের লটিয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ডান পাশে ছোট-বড় নানা রঙের প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে পাঁচ কক্ষবিশিষ্ট একটি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। সড়কটি দিয়ে যাতায়াতকারী পথচারীরা এক পলক দেখে থেমে যান। বাড়িটির কাছে এগিয়ে গিয়ে ছুঁয়ে দেখেন। পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে এত মজবুত ও দর্শনীয় ডিজাইনের বাড়ি নির্মাণ করা যায় তা ভেবেই নানান প্রশ্ন করেন পথচারীরা। আর এসব প্রশ্নের যৌক্তিক সব উত্তর দেন শফিকুল ইসলাম।
বোতলবাড়ির উদ্যেক্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, পথে-ঘাটে প্লাস্টিকের বোতল পড়ে থাকতে দেখে আমার মাথায় বুদ্ধি আসে যে, এই প্লাস্টিকের বোতলগুলোকে কাজে লাগানো যায় কিনা। এসব বোতল মাটিতে বা পানিতে নষ্ট হয় না, শুধু পরিবেশ দূষিত হয়। এগুলো কাজে লাগানো গেলে পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? এ প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
তিনি জানান, পত্রিকায় দেখেন জাপানে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে, যা খরচও কম পড়ে এবং ভূমিকম্প সহনীয় ও অগ্নিনির্বাপক ও পরিবেশবান্ধব। পরে ইউটিউবে দেখেন কীভাবে এই বাড়ি বানানো যায়। তা দেখে সে বোতল সংগ্রহের কাজে বেরিয়ে পড়েন।
প্রায় ৬০ হাজার বোতল সংগ্রহের পর রাজমিস্ত্রিকে নিয়ে নিজে নিজেই নকশা তৈরি করে বাড়ির কাজ শুরু করেন। প্রথম প্রথম অনেকেই তাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু ছয় মাস সময়ের মধ্য বাড়ির কাজ দৃশ্যমান হওয়ায় সবাই এ কাজের প্রশংসা করছেন। এখন বাড়িটি দেখতে অনেকেই ভিড় করছেন। ৩০ ফুট প্রস্থ ও ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্য প্লাস্টিক বোতলবাড়ির প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, মাত্র ছাদের কাজটুকু বাকি রয়েছে। ছাদ হবে ইটের ঢালাই বা টিনের। দরজা-জানালা হবে যথাক্রমে স্ট্রিল ও কাঠের। অর্থের কারণে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে।
দেখা গেল প্রায় ৬০ হাজার পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতল দিয়ে চার কক্ষবিশিষ্ট নির্মিত বাড়িটি দুটি শয়নকক্ষ, একটি ডাইনিং, একটি কিচেন ও একটি শৌচাগার রয়েছে। শফিকুল ইসলাম বলেন, মানুষের কথায় প্রথমে মন খারাপ হলেও এখন আমি অনেক খুশি। আমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছি। আমি যতটুকু জানি, এ বাড়ি নির্মাণে খরচ কম পড়বে এবং পরিবেশের উপকার হবে ও পরিবেশের ক্ষতিকর ইটভাটার ওপর নির্ভশীলতা কমে আসবে।
অন্যদিকে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহারের ফলে পরিত্যক্ত বোতলের ফলে পরিবেশের যে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল সেটিও কমে আসবে। আশা করি আমার দেখাদেখিতে অনেকে ইটের পরিবর্তে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে বাড়ি বানাতে আগ্রহী হবেন।
রাজমিস্ত্রি মো. আলমগীর জানান, বাড়ি শফিকুল ইসলামের নকশা করা। আমাকে যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবে করা হয়েছে। প্লাস্টিক বোতলে বালুভর্তি করে প্রথম ১৫ ইঞ্চি, এর পর ১০ ইঞ্চি এর পর ৫ ইঞ্চিতে দেয়াল গাঁথা হয়েছে বালুমিশ্রিত সিমেন্ট দিয়ে, আর এর ঢালাই দিয়ে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে।
কিন্তু লিনটার ও কলামে ব্যবহৃত হয়েছে ইট, সিমেন্ট ও রড। এ বাড়িতে কোনো ফাউন্ডেশন দেয়া হয়নি। প্রায় ৬০ হাজার পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতলে চার কক্ষের বাড়িটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি বোতলে বালু ভরে তা ইটের বদলে ব্যবহার করা হয়।
হোমনা পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মো. তোফাজ্জল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্লাস্টিক বোতল দিয়ে বাড়ি তৈরি একটি ব্যতিক্রম উদ্যোগ। বাড়িটি আমি দেখেছি। এটি ইটের তৈরি বাড়ি থেকে চারগুণ বেশি শক্তিশালী। প্লাস্টিক বোতলবাড়ি ৮.১ মাত্রা ভূমিকম্পতে যেখানে সাধারণ ইটের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এই বাড়িতে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না।
তা ছাড়া এই বাড়িটি আগুনেও বড় ধরনের ক্ষতি হবে না। এই বাড়িতে শীতে গরম আর গরমে ঠাণ্ডা অনুভব হবে।
এ বিষয়ে হোমনা পৌরসভার মেয়র ও লটিয়া গ্রামে মো. নজরুল ইসলাম জানান, বাড়িটি তিনি দেখেছেন। বাড়িটি দেখতে বেশ সুন্দর। যতটুকু জেনেছি, এ রকম বাড়ি করতে খরচও কম পড়ে এবং পরিবেশবান্ধব।
তা ছাড়া আমার গ্রামে এমন একটি উদ্যোগ সত্যই প্রশংসনীয়। এ গ্রামে প্রতিদিন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিকসহ শতশত লোক আসে বাড়িটি দেখার জন্য। আমি শফিকুলকে পৌরবাসীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সূত্র: যুগান্তর।
স্ব.বা/শা