আল-আফতাব খান সুইট, বাগাতিপাড়া:
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই দীর্ঘ প্রায় ৫৭ বছর ধরে কবিতা ও গল্প গ্রন্থ রচনা করে চলেছেন নাটোরের বড়াইগ্রামের অলোকা ভৈৗমিক নামে এক গৃহবধু। স্থানীয় লেখক কবি ,ছড়াকাররা তাকে চারণ কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। ৭৩ বছর বয়সী নিঃসস্তান অলোকা ভৌমিক স্বামীকে হারিয়েও দিশেহারা হননি। স্বামীর ভিটায় পরবাসী হয়েও অজোপাড়া-গাঁয়ে আধপেটা খেয়ে তা থেকে সঞ্চিত অর্থে কাগজ-কলম কিনে লিখছেন কবিতা ও প্রবন্ধ। বয়স্ক ভাতা ও সজনদের পাঠানো অর্থ থেকে যৎসামান্য সংসার খরচের অর্ধেকটা বাঁচিয়ে প্রতি বছর পাবনার রুপম প্রকাশনার মাধ্যমে অর্ধেক খরচে বের করেন একটি করে বই। বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থেকে প্রশংশিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। এখন জীবনের শেষ প্রান্তে সরকারীভাবে পুরস্কৃত হওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুণছেন অখ্যাত পাড়াগাঁয়ের এই চারন কবি অলোকা ভৌমিক।
১৯৪৭ সালের ১০ জানুয়ারী নাটোর জেলার শ্রীরামপুর গ্রামে বাবা জোতিষ চন্দ্র সরকার ও মাতা চমৎকারিনী সরকারের সংসারে জন্ম গ্রহণ করেন অলোকা। তৎকালীন সময়ে মেয়েদের লেখাপড়ার পরিবেশ ও সুযোগ না থাকায় বেশী লেখা পড়ার সুযোগ না থাকায় স্কুলের গন্ডি পেরুতে পারেননি।
অলোকা ভৌমিক বলেন, কৈশর পেরুনোর আগেই ১৬ বছর বয়সে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার তিরাইল গ্রামে যাযাবর স্বামী বিশ্বনাথের বাড়িতে বধু হয়ে আসেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেড়োতে পারেননি তিনি। তাই শিশু শিক্ষা নিয়েই শুরু হয় তার পথ চলা। কোমল হৃদয়ে স্বামীর কড়া শাসন আর মাতৃত্বের যন্ত্রণা যখনই ক্ষত তৈরী করেছে তখনই কাগজ-কলম হাতে নিয়ে মুক্তি লাভের পথ খুঁজেছেন। নিভৃতে জীবন যাপনকালে গহীন বুকে করেছেন কবিতার চাষ। একমুঠো ভাতের কষ্টে কতদিন যে চোখের পানিতে লেখার খাতা ভিজে গেছে, তা মনে পড়লে চোখবেয়ে এখনও অশ্রæ্র গড়ায় অলোকা ভৌমিকের। বেকার স্বামী ভিটে মাটি বিক্রি করে দিলে ঘর ছাড়া হন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর ভিটাতেই আশ্রয় পান ক্রেতার বাড়িতে। লেখালেখির প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকে অলোকা ভৌমিক তার জীবনের অ¤øমধূর অনুভূতিগুলো শব্দমালায় রুপান্তর করে চলেছেন ৫৭ বছর ধরে। কৈশর থেকেই কাব্য চর্চার প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক ছিল তার। এখন সব হারালেও কাব্যকে অঁকড়ে ধরে লড়াই করে চলেছেন। পেটের ক্ষুধা জিইয়ে রেখে মনের ক্ষুধা মিটিয়ে চলেছেন কবিতা,গল্প ও প্রবন্ধ লেখে।। তার বইগুলো হল- অমৃত, অমিয় বাণী, অমিয় সুধি (সনাতন ধর্ম বিষয়ক), একগুচ্ছ কবিতা (কাব্যগ্রন্থ), সেতুবন্ধন(কাব্যগ্রন্থ),সম্মিলিত কাব্যগ্রন্থ(কাব্যগ্রন্থ),্এক মুঠো রোদ্দুর(কাব্যগ্রন্থ),্ ছোট-বড় কবিতা(কাব্যগ্রন্থ), নারীর আতœকথা, উদয়ের পথে( প্রবন্ধ)। এবারের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার ১২তম বই অতৃপ্ত সনাতন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার একটিই চাওয়া.তা হচ্ছে সরকারীভাবে পুরস্কৃত হওয়া।
লেখক অলোকা ভৌমিকের পরিচিতিতে পাবনার বাংলাদেশ কবিতা সংসদের সভাপতি মানিক মজুমদার লিখেছেন ,অলোকা ভৌমিক একজন চারন কবি। তিনি অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। তাঁ প্রতিটি লেখা সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় জীবন ঘনিষ্ট এবং মানব জীবনের লোকজ শিল্প পরিলক্ষিত।তাঁর রচিত কবিতা,গল্প,প্রবন্ধ কাব্যানুরাগী পাঠক মহল সহ সর্বস্তরে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সনদ না থাকলেও ভাষার বুনন বিস্ময়কর,তাঁর হৃদয় নিঃসৃতলেখায় খুজে পাওয়া যায় অরণ্য দ্যুতির আলোকচ্ছটা।
সরেজমিন তিরাইল গ্রামে আলোকা ভৌমিকের অশ্রয়স্থল গৃহবধু হামিদা বেগমের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় অলোকা ভৌমিকের সাথে। তিনি বলেন,স্বামীর ভিটায় তিনি এখন পরবাসী। হামেদা এই ভিটা কিনে নেয় তার স্বামীর কাছে থেকে। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি আশ্রয়হীন হয়ে পড়লে হামিদা তাকে আশ্রয় দেন। তার দেখাশুনার ভার নেয় হামিদা। ভিন্ন ধর্মের মানুষ হলেও হামিদা তাকে খুব ভালবাসে। বয়সের ভারে চলতে কষ্ট হলেও হামিদার ওপর ভর করেই চলেন তিনি। প্রতিবেশীরা তার খোঁজ খবর রাখেন।
প্রতিবেশী সাবেক ইউপি সদস্য ও স্কুল শিক্ষক আব্দুল লতিফ মাষ্টার বলেন, বিধবা অলোকা ভৌমিকের নিজের বাড়ি নেই। স্বামী বিশ্বনাথ ভৌমিকের মৃত্যুর আগে শেষ সম্বল ভিটেটুকুও হামেদা বেগম নামের এক মহিলার কাছে বেঁচে দেন। প্রত্যন্ত গ্রামে এমন মহিয়সী নারীর লেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে অলোকা ভৌমিককে সদ্য কেনা বাড়িতেই আশ্রয় দেন হামেদা বেগম। নেন তার দেখাশোনার ভার। বয়স্ক ভাতার সামান্য টাকা, ইউনিয়ন পরিষদের ভিজিডি সহায়তা আর ভাইপো প্রদ্যুত সরকারের দেয়া মাসিক ৪ হাজার টাকায় কোনমতে খেয়ে-পড়ে দিন চলছে অলোকা ভৌমিকের।নেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তবুও ভাষার বুনন বিস্ময়কর। নিভৃতে জীবন যাপনকালে গহীন বুকে করেছেন কবিতার চাষ। তার লেখায় রয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। নবীজির জীবনী থেকে শুরু করে,রাধা কৃষ্ণ সহ বিভিন্ন ধর্মের দেবদবীসহ নাটোরের রানী ভবানী,রানী রাসমনীর জীবন কাহিনী নিয়ে তার লেখা বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি যার আশ্রয়ে রয়েছেন তিনিও মুসলমান। অথচ তাদের দুজনের যে ভাব তা সত্যি ইর্ষনীয়। তাদের একত্রে বসবাস অসাম্প্রদায়িক চেতনার অংশ।
হামিদা বেগম বলেন, মানবিক কারনে অশোকা দিদিকে কোথাও যেতে দেননি। তার সংসারেও রয়েছে অভাব অনটন। তবুও লেখালেখির জন্য যা যা প্রয়োজন হয় তা দিয়েই সহায়তার চেষ্টা করেন তিনি। বয়স্ক ভাতার সামান্য টাকা, ইউনিয়ন পরিষদের ভিজিডি সহায়তা আর ভাইপো প্রদ্যুত সরকারের দেয়া মাসিক ৪ হাজার টাকায় কোনমতে খেয়ে-পড়ে দিন চলছে অলোকা ভৌমিকের। তার প্রকাশিত বই তিনি বাড়ি বাড়ি বিলি করে আসেন। কোন বইয়ের জন্য টাকা নেনা অশোকা দিদি।
অশোকা ভৌমিক বলেন.তিনি এবার নাটোর বই মেলায় গিয়েছিলেন । ওই মেলায় মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে তার লেখা এবারের বই অতৃপ্ত সনাতন। শুুধু মোড়ক উন্মোচন করেই শান্তনা পেতে হয়। অখ্রাত হওয়ায় এক সময় মেলার মঞ্চে উঠতে গিয়ে বাধা পেতে হয়। অবশ্য বিশিষ্টজনরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলে ‘অতৃপ্ত সনাতন’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়। তার আশা এমন মেলার মাধ্যমে তিনি লেখনীর জন্য সরকারীভাবে পুরস্কৃত হবেন।
জেলা প্রশাসক মোহম্মদ শাহরিয়াজ বলেন, নাটোর কানাইখালী মাঠে আয়োজিত এবারের একুশের বই মেলার সমাপনী দিনে অশোকা ভৌমিকের একটি বইয়ের মোড়ক উন্