১৫ বছর পর জানা গেল তিনি ‘ডাক্তার’ নন

জাতীয়

স্বদেশবাণী ডেস্ক: কেরানীগঞ্জে আটিবাজারে ‘রাফিয়া ক্লিনিক’ এর মালিক ভুয়া ডা. মোহাম্মদ ওহেদুজ্জামানের ডাক্তারি সার্টিফিকেট নকল বলে ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমএন্ডডিসি)। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করেছে সংস্থাটি।

গত ৩০ জুন বিএমএন্ডডিসি এক বিজ্ঞপ্তিতে ওহেদুজ্জামানের প্রতারণার বিষয়টি তুলে ধরে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার ডা. মো. আরমান হোসেন।

জানা গেছে, কারো ডাক্তারি পাশের সার্টিফিকেট থাকলেও বাংলাদেশে এ পেশায় যুক্ত হতে হলে বিএমএন্ডডিসি থেকে অনুমোদন (রেজিস্ট্রেশন)  নিতে হয়। ওহেদুজ্জামান ডাক্তারি পেশায় যুক্ত হতে ২০০৬ সালে বিএমএন্ডডিসিতে আবেদন করেন। ডাক্তারি পাশের সার্টিফিকেট হিসেবে তিনি রাশিয়ার ‘দ্যা সেইন্ট পিটারসবার্গ স্টেট মেডিকেল একাডেমির সনদ জমা দেন। সেই সার্টিফিকেট দিয়ে তিনি ২০০৬ সালের ১৬মে বিএমএন্ডডিসির রেজিস্ট্রেশন নেন। রেজিস্ট্রেশন নং অ-৪২৫৭২।

এরপর তিনি কেরানীগঞ্জের আটিবাজারে একটি ভবন ভাড়া নিয়ে রাফিয়া ক্লিনিক খুলে বসেন। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি সেখানে ডাক্তারি পেশা শুরু করেন। প্রতিদিন শত শত রোগী দেখে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। এর পর বছর চারেক আগে ভাড়া ভবন ছেড়ে পাশেই কোটি টাকায় জমি কিনে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করে রাফিয়া ক্লিনিক স্থানান্তর  করেন।

রাফিয়া ক্লিনিকে মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে তিনি ফি নেন রোগী প্রতি ৪০০ টাকা। সম্প্রতি ওহেদুজ্জামানের প্রতারণার বিষটি জানতে পারে এলাকাবাসী। এরপর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি।

বিএমএন্ডডিসির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মোহাম্মদ ওহেদুজ্জামান প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে রাশিয়ার ‘দ্যা সেইন্ট পিটারসবার্গ স্টেট মেডিকেল একাডেমি থেকে ডাক্তারি পাশের যে সনদ দিয়ে বিএমএন্ডডিসির রেজিস্ট্রেশন নিয়েছিলেন, সেটি আসলে ভুয়া।

সোমবার দুপুরে রাফিয়া ক্লিনিকে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। তবে ক্লিনিকে রিসিপসনে থাকা এক নারী স্টাফ জানান, স্যার গত ১০-১২ ধরে ক্লিনিকে আসেন না। শুনেছি তিনি দেশের বাইরে আছেন। তার পাশে থাকা অপর এক নারী স্টাফ তাকে বাধা দিয়ে বলেন, না না স্যার দেশের বাইরে না, ঢাকার বাইরে আছেন। কবে নাগাদ তিনি (ওহেদুজ্জামান) ক্লিনিকে আসবেন? এসব প্রশ্নে তারা জানেন না বলে জানান।

আটিবাজারের বাসিন্দা কবির হোসেন বলেন, অসুখ হইলে উনার কাছে যাইতাম। এহন হুনি হে কোনো ডাক্তারই না। চিন্তা করছেন কত বড় বাটপার। ১৫ বছর ধইরা হে আমাগো লগে প্রতারণা করতাছে।

তারানগরের গৃহবধূ শিরিন আক্তার বলেন, ৬ মাস আগে একডা রোগের জন্য উনারে দেখাইছি। ৪০০ ট্যাহা ভিজিট নিছে আবার ৬ হাজার ট্যাহার টেস্ট করাইছে। কয় সব ভালা। আপনার কোনো রোগ নাই। ওষুধ লেইখ্যা দিছে। কিন্তু রোগ আর ভালা হয় না। পরে ঢাকাই গিয়া অন্য ডাক্তার দেখাইয়া ভালা হইছি। এখন শুনতাছি উনি নাকি ডাক্তারই না। বোঝেন কতবড় বাটপার।

আটিবাজারের দোকানদার আরমান হোসেন বলেন, ২০১৫ সালে ভাড়া ভবনে থাকতে রাফিয়া ক্লিনিকে অভিযান চালায় র‌্যাব। ওই সময় ডাক্তারি সার্টিফিকেট দেখাতে না পারায় ওহেদুজ্জামানকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু সে তখন লোকজনকে বুঝিয়েছে তার সার্টিফিকেট বাসায়, সঙ্গে না থাকায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জের বাস্তা ইউনিয়নের বাঘাশুর গ্রামের কৃষক সাদেক আলীর পুত্র মোহাম্মদ ওহেদুজ্জামান। স্থানীয়ভাবে এইচএসসি পাশ করার পর ওহেদুজ্জামান ঢাকায় চলে যান। কয়েক বছর পর তিনি গ্রামে ফিরে নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দেন।

বাঘাসুর গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, ওহেদুজ্জামান ডাক্তারি পেশা থেকে প্রচুর অর্থ আয় করেছেন। এই অর্থে আটিবাজারে নিজস্ব জমিতে গড়ে তুলেছেন রাফিয়া ক্লিনিক। যার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। বাঘাসুরে নিজ বাড়ির পাশে আরও একটি ক্লিনিক গড়ে তুলছেন তিনি। যেটি এখন নির্মাণাধীন। এছাড়াও বাঘাসুরের আশপাশে বিপুল পরিমাণ জায়গাজমি ক্রয় করেছেন। থাকেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আলিশান ফ্লাটে। মাঝেমধ্যে বাঘাসুরের বাড়িতে আসলেও এখন তাকে দেখা যায় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত দেবনাথ বলেন, তিনি (ওহিদুজ্জামান) ডাক্তারি পেশার মতো একটি মহান পেশার নামে লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে রোগী দেখে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। বিএমএন্ডডিসি তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করেছে বলে শুনেছি। তবে আমরা রাফিয়া ক্লিনিক ও তার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *