জোরদার করতে হবে অর্থনৈতিক কূটনীতি

জাতীয় লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশটির নতুন প্রশাসন কোভিড মোকাবিলা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

তবে বাংলাদেশের তরফ থেকে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের আরও জোরালো সমর্থন জরুরি। বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা বুধবার যুগান্তরের কাছে এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বরাবর স্থিতিশীল। বাইডেনের আমলেও স্থিতিশীল থাকবে। নতুন প্রশাসনের প্রথম অগ্রাধিকার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য তথা কোভিড মোকাবিলা করা এবং ট্রাম্প যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বিভাজন করেছে, সেটা মেরামত করা। সেটা থেকে উত্তরণ কঠিন কাজ।

তিনি বলেন, পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকার পাবে কানাডা ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার। ট্রাম্প আমলে ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি হয়েছিল। এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার দিকে নজর দেবে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনবিরোধী মনোভাব রয়েছে। বাইডেন সেটা এড়াতে পারবেন না। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। তারা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে ব্রিফিং দেয়। সেখান থেকে হোয়াইট হাউজে যায়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুবক জায়ান সিদ্দিকী হোয়াইট হাউজের চিফ অব স্টাফের দপ্তরের অ্যাডভাইজার পদ পেয়েছেন। চিফ অব স্টাফের দপ্তরের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের দৈনন্দিন যোগাযোগ হয়। জায়ান বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারেন। তবে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র বি ক্যাটাগরিতে রাখে। বাংলাদেশকে তাই নিজের গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বাইডেনের নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করায় বৈশ্বিক, আঞ্চলিক এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নবসূচনা হবে। বাইডেনের সরকার বিশ্বকে একটা বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থায় ফেরাবে। ডব্লিউএইচও, ডব্লিউটিও, পরিবেশ চুক্তি প্রভৃতিতে ফিরবে যুক্তরাষ্ট্র। বিভেদমূলক পদক্ষেপ পরিবর্তন হবে। বিশ্বনেতারা ঐক্যবদ্ধ হবে।

তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সুবাতাস বইবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বইবে স্বস্তি। ভারত ও চীনের সম্পর্কেও একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হতে পারে। ফলে বিষয়টা ইতিবাচক হবে।

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন অধিকারের বিষয়ে বাইডেন সরকারের সমর্থন বাড়বে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট, বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈরী পরিবেশের প্রভাব এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইতিবাচক হবে। এমনকি অভিবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা মানবিক দিক বিবেচনা করে সমাধান করা হবে। তা ছাড়াও বাংলাদেশে মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখার ব্যাপারে বাইডেন সরকার অনেক বেশি সংশ্লিষ্ট হবে।

আমেরিকান চেম্বার ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন আসার ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক সহযোগিতা হবে বলে আশা করি। ডেমোক্রেটিক পার্টি বাংলাদেশের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত থাকে। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাংলাদেশের সঙ্গে টিকফা সই হয়েছিল। বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালোই হবে বলে আশা করি।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগের সরকারের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি আছে। বৈদেশিক নীতিতে বড়ো পরিবর্তন হয় না। আমাদের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের পরও প্রতিযোগিতায় টিকে আছে। এটা আমাদের জন্য একটা সুবিধা। এখন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শীতল আছে। এই সুযোগ আমরা নিতে পারি। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক কূটনীতি ভালোভাবে করতে পারলে বাইডেনের আমলে সুবিধা পেতে পারি।

অ্যামচেমের সাবেক সভাপতি আফতাব উল ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সব সময় রাজনৈতিক কূটনীতি করে থাকে। অর্থনৈতিক কূটনীতি তেমন হয়নি। বাংলাদেশের কয়েকটি ইস্যু আছে। এগুলো গত চার বছরে উত্থাপন কতটা হয়েছে, সেই বিষয়ে আমি সন্দিহান। বাইডেনের সরকার ক্ষমতায় আসায় এখন এসব বিষয় তুলে ধরার সুযোগ এসেছে। কারণ, বাইডেন মুসলিম দুনিয়াসহ বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর প্রতি অনেক বেশি সুসম্পর্ক রাখার প্রতি আন্তরিক।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশকে জিএসপি দেওয়া বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি বাংলাদেশকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে ক্ষতি তেমন করেনি। তবে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো, বাংলাদেশ থেকে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপ করেছে। বাংলাদেশের এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে ১৬ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। অথচ ভারত ও চীন মাত্র পাঁচ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসব পণ্য রপ্তানি করতে পারে। পৃথিবীর মধ্যে শুধু বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার ওপর তারা এত বেশি শুল্ক আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এই শুল্ক প্রত্যাহার করলে আমরা মার্কিন ক্রেতাদের ১৬ শতাংশ কম দামে পোশাক ও বস্ত্র খাতের পণ্য দিতে পারতাম। কিন্তু এটা নিয়ে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার কোনো লবিস্ট গ্রুপ নিয়োগ করেনি।

আফতাব উল ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ১৩ বছর ধরে টিকফা করেছে। টিকফায় ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা হয়। কিন্তু টিকফায় বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয় না। আজ বাংলাদেশে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প হচ্ছে। সরকাররি-বেসরকারি অংশীদারি পিপিপি হচ্ছে। তার মধ্যে আমেরিকার কোনো কোম্পানি নেই। এগুলো চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া করছে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তিন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ সবই শুধু বিদ্যুৎ আর জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ। অন্য কোনো খাতে বড় বিনিয়োগ নেই।

তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ আজ ১৬ কোটি মানুষের বাজার। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় কোম্পানি আছে। এসব কোম্পানি ভারতে আসে। সেখান থেকে মাধ্যম হয়ে বাংলাদেশে এলে তাদের পণ্যের দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। ভারত থেকে নেপাল ও ভুটানের মতো বাংলাদেশকে একই মানদণ্ডে বিবেচনা করে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজার অনেক বড়। সরাসরি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে বাংলাদেশের মানুষের কর্মসংস্থান হতো; প্রযুক্তি হস্তান্তর হতো, যা জরুরি। আশা করি, বাইডেনের আমলে বাংলাদেশের সরকার এসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বলেছেন, জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের সরকারের প্রথম ১০০ দিনের অগ্রাধিকারে বাংলাদেশ সংক্রান্ত কোনো বিষয় থাকবে না। কারণ তাদের অনেক বেশি অগ্রাধিকার এজেন্ডা আছে। কোভিড, ন্যাটো, অভিবাসন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের অগ্রাধিকারে থাকবে। এতে আশাহত হওয়ার কারণ নেই। বাংলাদেশের ইস্যুগুলোও পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে আসবে। বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থনৈতিক ও রোহিঙ্গা ইস্যু। এসব ইস্যুতে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হলে গোটা অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়বে। এটা জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের সরকারকে বোঝাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কয়েকজন জেনারেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এটা যথেষ্ট নয়। মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। এভাবে চাপ দিলে মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে অগ্রসর হতে পারে। তবে মিয়ানমার এপ্রিল নাগাদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ওই সময়ে প্রত্যাবাসন শুরু না করলে যুক্তরাষ্ট্রকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *