হাত-মুখে গুলি লাগার পরেও লড়াই চালিয়ে যান ফরিদ মিয়া

সারাদেশ

স্বদেশবাণী ডেস্ক: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের রামপুর এলাকার ফরিদ মিয়া ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছেন ২ নম্বর সেক্টর এ। যুদ্ধের স্মৃতি এখনও আলোড়িত করে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ মিয়া কে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে তিনি চলে যান ভারতের অভয়নগরে। সেখানে প্রশিক্ষণের পর চলে যান মেলাগড়। মেলাগড় থেকে যুদ্ধের অস্ত্রসহ তিনি যাত্রা করেন মন্তুলি ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ।

দেশকে হায়েনা মুক্ত করতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ফরিদসহ আরও দেড়শ মুক্তিযোদ্ধাকে ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যান ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এস কে শর্মা।

রাত ১২টা ১ মিনিটে ভারতীয় সেনা সদস্যদের সঙ্গে ফরিদ মিয়া চলে যান  যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে সীমান্ত এলাকায় শক্ত ঘাঁটি নির্মাণ করে রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মিত্রবাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ধাতুর পিলারে অবস্থিত পাক বাহিনীর শক্তিশালী বাঙ্কার।

তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে অভয়নগরের সীমান্ত এলাকা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাক বাহিনী। রণক্ষেত্রের লড়াই চলে ভোর রাত পর্যন্ত। পাক বাহিনী পরাস্ত হলে ধাতুর পিলার ও তারাগঞ্জ এলাকার হাওড়গুলোর পাশে অবস্থান নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা।

পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণের জন্য হাওড়ের পাড়ে প্রস্তুত রাখা হয় মর্টারগান ও বিস্ফোরক। মর্টারগানগুলোর নিশানা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। সে সময় কাছের একটি ব্রিজে আর্টিলারি প্রস্তুত করছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

মিত্রবাহিনী আক্রমণের আগেই পাক বাহিনীর আর্টিলারি থেকে হঠাৎ ছোড়া একটি শেল আঘাত হানে মিত্রবাহিনীর রক্ষিত বিস্ফোরকের উপর। মুহূর্তেই ঘটে ভয়ানক বিস্ফোরণ। বাংলাদেশের মুক্তির যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করেন মুক্তিযোদ্ধাসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেক যোদ্ধা। আহত হন অনেকে। আহত একজন মুক্তিযোদ্ধার পেটের ভিতর থেকে সব কিছু বেরিয়ে আসতে থাকে,  গামছা বেঁধে তার রক্তক্ষরণ বন্ধের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে।

এরপর পাকিস্তানি আর্টিলারি থেকে মিত্রবাহিনীর উপর শুরু হয় অনবরত গুলি বর্ষণ। এক পর্যায়ে হাতে গুলি লাগে ফরিদের, ছিটকে পড়ে যান তিনি। আরও একটি গুলি ছেদ করে চলে যায় ফরিদের মুখ।

এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে ভারতীয় বাহিনীর আরও সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে। উদ্ধার করা হয় ফরিদকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতর এই মুক্তিযোদ্ধার শরীরে ব্যথানাশক প্রয়োগ করা হয়।

তারপরও রণে ভঙ্গ দেননি তিনি। একে একে ধাতুর পিলার ও তারাগঞ্জ মুক্ত করে দেবগ্রামের দিকে অগ্রসর হন তারা। পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটিগুলো যখন পরাস্ত, তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত ৩টা।

মুক্তিযোদ্ধারা আরও পশিমে এগিয়ে গিয়ে দেবগ্রাম স্টেশনে অবস্থানরত পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। বিপর্যস্ত পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাদের পিছু হটিয়ে একের পর এক এলাকা মুক্ত করে তাদের ঠেলে দেওয়া হয় আশুগঞ্জে। সেখানে পাক বাহিনী আবারও শক্তি সঞ্চয় করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মিত্রবাহিনীর অকুতোভয় অভিযানে আশুগঞ্জ থেকেও উচ্ছেদ করা হয় তাদের। সম্মুখ যুদ্ধে পরাস্ত পাক বাহিনী ভৈরবের ব্রিজ ভেঙে ফেলে। এ সময় যুদ্ধের সাময়িক বিরতিতে নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন মুক্তিযোদ্ধারা।

ভারতীয় বাহিনী তখন অবস্থান করছে আশুগঞ্জ রেললাইনের দক্ষিণপাশে, আর মুক্তিযোদ্ধারা রেললাইনের উত্তরপাশে। ঠিক এক ঘণ্টা পরে হঠাৎ আশুগঞ্জের বিশ্বগ্রামের গোডাউন থেকে পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারান ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রায় শতাধিক যোদ্ধা। তাদের উদ্ধার করে তুলে দেওয়া হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী হেলিকপ্টারে। এবার মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় ভারতীর সেনাবাহিনী আকাশপথে আর্টিলারি নিয়ে এসে কিশোরগঞ্জ থেকে আক্রমণ চালায় পাক বাহিনীর উপর।

তীব্র আক্রমণের মুখে পরাস্ত হয়ে ভৈরব থেকে পিছু হটে পাক বাহিনী। যুদ্ধ শেষ হলে স্পিডবোটে ভৈরব নদী পার হন ফরিদসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর যোদ্ধারা। কিন্তু ঘোড়াশাল পৌঁছানোর পরে দীর্ঘযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়েন আহত, কিন্তু মুক্তির লড়াইয়ে জাগ্রত ফরিদ ফিয়া। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ক্যপ্টেন এস কে শর্মা তাকে ক্যাম্পে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন।

অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র সমর্পণ করেন ফরিদ মিয়া। মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এস কে শর্মা তার হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সনদ তুলে দেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বপ্ন দেখেন বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’র, যেখানে থাকবে না কোনো অন্যায়-শোষণ-অবিচার। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তার চাওয়া, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে পরাস্ত করার বিরামহীন সংগ্রাম।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *