একাত্তরের বীরাঙ্গনা শিলা, মায়া ও মনোয়ারাদের অব্যক্ত কথা

সারাদেশ

স্বদেশবাণী ডেস্ক: স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা দিতে আর বাকী কয়েকটা দিন। কিন্তু যাদের শরীরের অংশ বিসর্জন দিয়ে এনেছে এই স্বাধীনতা, তাদের জন্য এই বাংলায় নেই একটু মাটিও। আজও ভাগ্যে জোটেনি মুক্তিযোদ্ধা উপাধিটুকু। এখনও বঞ্চনায় কাটছে মৌলভীবাজারের শিলা, মায়া, মনোয়ারা ও সবজান বিবির দিন। নিপীড়নের প্রায় ৫০ বছর পরও নিজের জীবনে সুখ তো খুঁজে পাননি, উপরন্তু ওই বিভীশিখাময় ঘটনার জের এসে পড়ে তাদের সন্তানদের ওপরে।

এক অনুসন্ধানে দেখা যায়- ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর এবং মানুষের তীর্যক কটাক্ষের কারণে অনেক বীরাঙ্গনাই স্বামী পরিত্যক্তা হন এবং বিবাহের পর তাদের মেয়েরা পুনরায় তাদের উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদেরও খারাপ দৃষ্টিতে দেখে কিছু মানুষ। জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার শিলা গুহ, মায়া খাতুন, মনোয়ারা, সাফিয়া খাতুন প্রত্যেকেই স্বামী পরিত্যক্তা হয়েছেন। এদের মধ্যে সাফিয়ার সন্তান নেই। বাকী তিনজনকেই সন্তানদের কষ্ট করে বড় করতে হয়। এমনকি বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়ী ছেড়ে মায়ের কাছে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এদের অনেকেই ভূমিহীন, অন্যের বাড়িতে কাজের বিনিময়ে আশ্রিত বা ভাড়া বাসায় কোনও রকমে অতিবাহিত হয় তাদের জীবন। তাদের অনেকের কাছে এখনও তারা পরাধীন, জীবনের স্বাধীনতা পাবেন কিনা তা নিয়েই তাদের যত উদ্বেগ। তাঁদের প্রত্যেকেরই রয়েছে পৃথক পৃথক গল্প। একেক জনের গল্প শুনলে আজও শিউরে ওঠে শরীর। নিজের অজান্তেই চোখে আসে অশ্রু। অথচ নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দেয়া এই বীর মাতাদের জীবন কাহিনীই স্বাধীন বাংলার ইতিহাস। আর তাদের এ ত্যাগই স্বাধীনতা।

আজকে আমাদের মুক্তভাবে নিঃশ্বাস ফেলার স্বাধীন বাংলাদেশ তাদেরই ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া। আজ পাঠকের কাছে তুলে ধরছি একাত্তরে নির্মম নির্যাতনের শিকার শিলা সাহা বিয়ের পর পরিবর্তিত নাম শিলা গুহর জীবন কথা।

শিলা গুহ’র জবানবন্দী
১৯৭১ সাল। তখন বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ছিলো যাত্রাপালা। স্থানীয় মানুষের বিনোদনেরও অন্যতম মাধ্যম ছিলো যাত্রা। যুদ্ধকালে যাত্রাদল মুন লাইট অপেরার নায়িকা ছিলেন শিলা গুহ। দলের সঙ্গে শিলা গুহ তখন রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলার অলিপুরে যান। পুরো দলের সাথে অলিপুর কলেজের একটি কক্ষে থাকার ব্যবস্থা। হঠাৎ করেই দেশে মুক্তিকামী মানুষের ওপর হানাদারদের বর্বর হামলা, কলেজের সীমানা প্রাচীর না থাকায় পাশেই সীমানা প্রাচীরঘেরা বৃদ্ধমান অলিপুর বালিকা বিদ্যালয়ে চলে আসে পুরো দল।
পাশেই নাট মন্দির। যাত্রা হওয়ার কথা সেখানেই। রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেলে তিনি তাঁর নিজের দেশ (এলাকা) বাগেরহাটে ফিরতে পারছিলেন না। প্রায় দুই মাস সেখানে আটকা। শীলার গায়ের রং দেখতে উজ্জ্বল শ্যামলা হলেও শরীরের গঠন, মুখের মিষ্টি চেহারায় অনেকটা আকর্ষণীয় ছিলেন। যাত্রার নায়িকা হিসেবে তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁকে দেখার জন্য তার “বই” যাত্রার গল্প অনেকে দুইবার দেখতেন।

বেশ কিছু যাত্রাপালার কাহিনীতে তিনি তাঁর ইজ্জত হননের অভিনয় করেছেন। কিন্তু বাস্তবে যে নির্মমভাবে তাকে ইজ্জত দিতে হবে, তা কোনওদিন ভাবতেও পারেননি। তখন দেশীয় শত্রুরা খান সেনাদের প্রিয়ভাজন হতে আওয়ামী লীগ নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের ধরিয়ে দিতো। সাথে খান সেনাদের হাতে তুলে দিতো যুবতী নারী ও কম বয়সী গৃহবধূদের।

সেখানে অবস্থানকারী খান সেনাদের নারী সরবরাহকারী রাজাকার শাহাব উদ্দিনসহ অনান্য রাজাকারদের দৃষ্টি যায় যাত্রাদলের মেয়েদের দিকে।

একদিন সন্ধ্যার একটু আগে রাজাকাররা একটি জীপে করে পাকসেনা নিয়ে হাজির হয় অলিপুর গার্লস স্কুলে। পুরুষরা তখন বাইরে। শিলা তখন স্কুলের বারান্দায় বসে ছিলেন। অস্ত্রের মুখে শিলাগুহ, সবিতা ও মিনু নামে যাত্রাদলের তিন যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় ডাকবাংলোয়।

দেখতে বেশ আকর্ষণীয় হওয়ায় শিলাকে ঘন ঘনই যেতে হতো ক্যাম্প কমাণ্ডারের কাছে। কমাণ্ডারের কক্ষ থেকে ফিরে আসার পর আরও কয়েক জনের নির্যাতন সইতে হতো তাঁকে। তিনি জানান- এক কক্ষে আরও কয়েকজন ছিলো, একসাথে ইজ্জত হনন করতো তারা। তখন সবাই মিলে কাঁদতো। এ কান্নার শব্দে পুরো কক্ষ ভারী হয়ে যেতো। কিন্তু এক কক্ষে থাকার পরও রাজাকার ও পাক সেনাদের কানে এই কান্নার শব্দ পৌঁছাতো না।

এর পর চলত অমানবিক নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতনের সময় অজ্ঞান হয়ে গেলে কখনও সিগারেটের স্যাঁকা দিয়ে, কখনও গরম চায়ের কাপে আঙ্গুল ডুবিয়ে জ্ঞান ফেরাত হায়েনার দল। এভাবে কিছুদিন অতিক্রম হওয়ার পর একদিন জ্ঞান না ফিরলে তারা শিলাকে মৃত ভেবে একটি ধান ক্ষেতে ফেলে দেয়।

পর দিন সকালে সেখান থেকে স্থানীয় আবুল হোসেন ও তার ভাই সাত্তার মৃতদেহ দেখতে গিয়ে দেখেন শিলা গুহ শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলছেন। সাথে সাথে দুজনের গায়ের শার্ট খুলে শিলার দেহে জড়িয়ে তারা তাকে তুলে নিয়ে যান এবং তাদের বাড়ির পাশে একটি হিন্দু বাড়িতে রেখে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করেন। তাদের দেখাশোনা করতেন জন্য যাত্রাদলের মিনু ও তার স্বামী সুবাস। খবর যায় খান সেনাদের কাছে। খান সেনারা খবর পাঠায় শিলাকে ক্যাম্পে পাঠাতে।

কিন্তু আবুল ও সাত্তার শিলাকে পাঠাতে অস্বীকার করেন। এ সময় আবুল মধু নামে এক লোককে দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেন অন্যত্র। ক্ষিপ্ত হয়ে পাকবাহিনী আবুল হোসেন ও তার ভাই সাত্তারকে ধরে নিয়ে ভুরুঙ্গামারী রাস্তায়, চিলমারিতে হত্যা করে। এদিকে, মধু শিলাকে নদী পার করে খেরবাড়ির রাস্তা দিয়ে নিয়ে যায় তাদের বাড়িতে (গ্রামের নাম তিনি বলতে পারেন না)। সেখানে গিয়েও বিপত্তি। কয়েকদিন থাকার পর ওপারের খবর চলে যায় তাদের গ্রামে। মধুর পরিবারের লোকজন তাকে চলে যেতে বলে। কিন্তু মধুর এক কাকা তাকে একা যেতে দেয় না। তাঁরা ভাবেন তাদের বাড়িতে এসে যদি শিলাকে না পায় আবুল ও সাত্তারের মতো তাদেরও মেরে ফেলতে পারে। তাই তারা সবাই মিলে ভারতে রওয়ানা হন।

শিলা জানান, ভারত যেতে তাদের দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয়। যাওয়ার পথে শিলার জীবনে ঘটে আরও একটি ঘটনা। তাদের সাথে এক শরনার্থী মহিলা ছিলেন পোয়াতি (সন্তান সম্ভবা)। পথেই প্রসব ব্যথা ওঠে তার। কিন্তু কেউই এগিয়ে যান না। শিলা রাস্তার পাশেই আবিস্কার করেন একটি বড় গর্ত। তখন ওই মহিলাকে নিয়ে সে গর্তে যান। গর্তের একপাশ মলে ভরপুর ছিলো। তখন বাচ্চা বের হয়ে যাচ্ছিল।

শিলা ওই মায়ের বাচ্চাটি গর্ভদানী থেকে টেনে বের করেন। ওই মায়ের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। তখন শিলা খুবই বিপদে পড়েন। সন্তান জন্ম দেয়া মায়ের নারী কাটার কিছু ছিলো না। এক সময় শিলা তাঁর কাপড়ের এক মাথা দিয়ে নাড়ি বেঁধে নিজের দাঁত দিয়ে নাড়ি কাটেন। পরে তিনি ওই মহিলার নাড়ি থেকে বের হয়ে আসা ফুল তার হাতে নেন এবং মায়ের কাছে ছেলেকে দেন। কিছু দূর গিয়ে নরম মাটি পেয়ে তিনি গর্ভফুলটি মাটিতে চাপা দেন।

শিলা জানান, ভারত যাওয়ার সময় টানা ২/৩ দিন তিনি কিছু খেতে পাননি। শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছিল। এক সময় তিন দিন পর পথে এক লোকের থেকে এক চামচ পাতলা খিচুড়ি এক টাকা দিয়ে কিনে খান। এক সময় শিলা ভারতে পৌঁছান। ভারতে বিভিন্ন স্থানে ঘোরেন। সেখান থেকে তিনি ট্রেনে চড়ে কয়েক দিনে আসেন ত্রিপুরার কমলপুরে। সেখানে এক মুক্তিযোদ্ধার সাহায্যে আরও কয়েকজন নারীর সঙ্গে সেখানে থাকেন।

এক সময় দেশ স্বাধীন হয়। শিলা ফেরেন দেশে। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে শিলা বাগেরহাটের পেঁয়াজহাটির কচুর হাঠখোলায় নিজের বাড়িতে ফেরেন। বাবা বিহারী লাল সাহা ইতিমধ্যেই মেয়েকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ পান দলের অন্যদের কাছ থেকে। তার অপর ছেলে-মেয়েদের কথা চিন্তা করে তার বাবা তাকে বাড়িতে জায়গা দেননি। সেই থেকে ঠিকানাহীন শিলা। আজও নিঃস্ব।

তখন কামাল খাঁ নামে এক যাত্রা শিল্পীর মাধ্যমে আবারও যোগ দেন যাত্রাদলে। বনশ্রী ওপেরা। নিজেকে সব সময় যাত্রায় নিমজ্জিত রেখে জীবনের এই দুঃখ ভুলে রাখতে চান। কয়েক বছর পর যাত্রাদলের গাড়ি চালক যতিন গুহের সাথে তার বিয়ে হয়। শিলা সাহা থেকে তাঁর টাইটেল হয় শিলা গুহ। অনেকটা সুখের নাগাল পান শিলা। তাদের সংসারে দুটি মেয়েও হয়। কিন্তু সে সুখ তাঁর কপালে সয়নি।

৬ বছর পর স্বামী যতিন গুহ তার এক পিশতুতো বোনের মাধ্যমে জানতে পারেন শিলা বীরাঙ্গনা। আশেপাশের লোকজনও তা জানত। যতিন এই অবস্থায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। ওই সময় যতিন পিরোজপুরে তাঁর মাকে দেখে আসার কথা বলে শিলার কাছ থেকে বিদায় নেন। যাবার সময় যতিন শিলাকে বলেছিলেন- আসার সময় কি আনবো। শিলা বলেছিলেন- আমার জন্য এক কৌটা সিঁদুর নিয়ে এসো। কিন্তু স্বামীর কাছ থেকে শিলার আর সিঁদুর পাওয়া হয় না। সেই যে যতিন বের হয়েছিলেন আর ফেরেননি।

আবারও মাথার উপর থেকে সরে যায় ছায়া। স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে জামালপুর, পিরোজপুর সর্বশেষ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে এসে আশ্রয় নেন শিলা। এখানেই যাত্রার দলে কাজ করেন। শিলা জানান, তিনি মিনারভা, নিউ মিনারভা, বনশ্রী, গীতাশ্রী, রংমহল, বঙ্গশ্রী, মুনলাইট, আর্য ওপেরা ও সাধনাসহ অনেকগুলো যাত্রা দলের সঙ্গে কাজ করেছেন। যাত্রার দুর্দিনের পর বাসার কাজ করে দুই মেয়েকে বড় করেন। অনেক কষ্ট করে বিয়েও দেন। বিয়ের পর বড় মেয়ে স্বামীর বাড়িতে সংসার করলেও ছোট মেয়ে এক সন্তান নিয়ে ফিরে আসে তার কাছে।

 

তাই এখন তিনটি পেট চালাতে হয় তাঁকে। থাকেন ভাড়া বাড়িতে। বর্তমানে বয়স হয়েছে শিলা গুহের। যাত্রাও নেই। কাজও করতে পারেন না। মানুষের কাছে হাত পেতে সাহায্য এনে চলে সংসার। সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা দিচ্ছে। বিষয়টি তিনি আগে জানতে পারেননি। জানার পর আবেদন করেছেন। কিন্তু এখনও যাচাই-বাছাই শেষ হয়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য
শিলার মুখ থেকে এই কাহিনী শোনার পর তৎকালীন রংপুর জেলার বর্তমান রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলার অলিপুরের একাত্তরের প্রত্যক্ষদর্শী কিছু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়।

১১নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা অলিপুরের বাসিন্দা রবিউস সামাদ জানান, তখন তিনি যুদ্ধে। অলিপুর বালিকা বিদ্যালয়ে যাত্রাদলের দল আটকা পড়েছিল তা দেখেছেন। তবে যুদ্ধ থেকে এসে শুনেছেন শাহাব উদ্দিন ও খড়কু রাজাকারের মাধ্যমে যাত্রাদলের নায়িকাসহ অনান্য মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে হানাদার বাহিনী। যে অপরাধে যুদ্ধ চলাকালে তার কোম্পানী শাহাব উদ্দিন রাজাকারকে হত্যা করে।

এ ব্যাপারে অলিপুর ডাক বাংলোর তৎকালীন চৌকিদার বনিক উল্লাহ জানান, ডাক বাংলোয় রাজাকারদের মাধ্যমে অনেক মেয়ে ছেলে এসেছে। শারীরিক নির্যাতন শেষে অনেক মেয়েকে মেরে মাটি চাপাও দিয়েছে। কাউকে কাউকে ফেলে দিয়েছে অন্যত্র। শিলা গুহকে আনা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান- শিলাগুহকে তিনি চিনতেন না। তবে যাত্রা দলের মেয়েদেরও আনা হয়েছে। অনেককেই মেরে ফেলেছে পাক সেনারা।

এ ব্যপারে কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দা ও যুদ্ধের প্রথম দিকে এলাকায় অবস্থান করা গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব পরিমল মজুমদার মুকুলের সাথে। তিনি জানান- যুদ্ধের শুরুর দিকে প্রথমে কলেজে, পরে গার্লস স্কুলে আশ্রয় নেয় যাত্রাপালার একটি দল। অনেকে পালিয়ে গেলেও বেশ কয়েকজন মেয়ে-ছেলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় তারা সেখান থেকে যেতে পারেনি। যাত্রাদলের নায়িকাসহ তিনজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা কিছুক্ষণ পরেই প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তিনি জেনেছেন।

তবে তিনি জানান, তার ধারণা ছিলো এদের সবাইকে মেরে ফেলেছে পাকবাহিনী। ওই যাত্রা দলের নায়িকা শিলা বেঁচে থাকার বিষয়টি ৪৯ বছর পর জানলেন। পরিমল মজুমদার বলেন, ওই বালিকা বিদ্যালয়ে শিলা ও তার দলের যাত্রার পোষাকসহ অনান্য সামগ্রী স্বাধীনতার প্রায় ১০ বছর পরও সংরক্ষিত ছিলো। পরে সংরক্ষণের অভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষ অন্য একটি যাত্রা দলের কাছে তা বিক্রি করে দেন।

এ ব্যাপারে ৪নং সেক্টরের কমলপুর ক্যাম্পের কোম্পানী কমাণ্ডার আবু হাসনাত কর্তৃক এক প্রত্যায়ন পত্রের মাধ্যমে জানা যায়- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতের খোয়াই এলাকায় শিলা গুহের সাথে তার দেখা হয় এবং তাঁর পাকবাহিনী ও দেশীয় রাজাকার কর্তৃক তার নির্যাতনের বিষয়টি অবগত হন।

তিনি জানান, বিষয়টি তাদের প্রশিক্ষক মোস্তফা শহীদকে অবগত করেন। মোস্তফা শহীদের নির্দেশক্রমে তাকে আরও কয়েকজন নারীর সাথে তাদের থাকার সুযোগ করে দেন।

এদিকে, একাত্তরের বীরাঙ্গনা শিলা এখন মানুষের কাছে হাত পেতে নিজের সংসার পরিচালনা করছেন। জীবনের এই শেষ বেলায় এসে তাঁর দাবী- তাঁর প্রাপ্য মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ও মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া একটি বাড়ি পেলে অন্তত জীবনের পড়ন্ত বেলায় স্বাধীন দেশে পরাধীনতা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে কিছুটা সুখ নিয়ে পরপারে যেতে পারবেন।

একাত্তরে সম্ভ্রম হারানো মায়া এখনও পরাধীন ও আশ্রয়হীনা
আর কয়েকদিন পরই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। দেশজুড়ে হবে উৎসব। চলছে নানা প্রস্তুতিও। কিন্তু যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীন বাংলা তাঁদের অনেকেই আজো অবহেলিত। তাদের কারো কারো চোখে এখনও সেই অন্ধকার ঘোর অমানিশা। এমনই একজন মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের ষাড়েরগজের মায়া খাতুন। মায়া খাতুনের পিতার নাম আব্দুল বারী, মায়ের নাম সমিত্তা বিবি।

মায়া খাতুনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলার মানুষ নিরবিচ্ছিন্ন ভুখন্ড পেলেও মায়ার ভাগ্যে জোটেনি এক চিমটি মাটি। পরের জমিতে পরের ঘরে থেকেই জীবনের শেষ বেলায় এসে দাঁড়িয়েছেন। সরকারের কাছ থেকে ভূমিহীন হিসেবে জমি-ঘর পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকার নিশ্চয়ই এই যুদ্ধমাতা মায়াকে একটি ঘর তৈরী করে দেবেন। সরকার সম্ভ্রম হারানো মায়েদের মুক্তিযোদ্ধা উপাধিও দিচ্ছে।

দিবালোকের মতো স্পষ্ট মায়ার জীবনে ঘটে যাওয়া বিভীশিখাময় ঘটনাগুলো। যার অনেক প্রত্যক্ষদর্শীও বিদ্যমান। তবুও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি মুক্তিযোদ্ধা উপাধিটুকু। আজো নেই নিজের একটি বাড়ি।

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখাঁন ইউনিয়নের ষাড়েরগজ গ্রামের মায়া খাতুন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাড়ির পাশে জানাউড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাক বাহিনীর ক্যাম্প বসে। এক দুপুরে গোসল করার সময় পাক সেনার চোখ পড়ে মায়ার ওপর। মায়া গোসল সেরে ঘরে আসতে না আসতেই তারা এসে হাজির হয় তার বাড়িতে। মায়া ভয়ে চৌকির নিচে আত্মগোপন করেন। মা দরজায় বসে ভাত খাচ্ছিলেন। বুট দিয়ে থাল সরিয়ে চৌকির নিচ থেকে মায়াকে বের করে আনে পাক সেনারা। মায়া ও মায়ার মা দুজনেই পাক সেনাদের পায়ে পড়ে প্রাণ ও ইজ্জত ভিক্ষা চান, কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।

জোর করে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। টানা ৫ দিন সে কি নির্যাতন! রাজী না হলে বুকে বুটের পারা আর বন্দুকের নল চোখের সামনে। মা বাবার একমাত্র মেয়ে মায়া। মেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর দু’জনই পাগল প্রায়। বহু জায়গায় ধর্ণা দিয়েও মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে পারেননি বাবা।

টানা পাঁচদিন পর স্থানীয় একজনের সাহায্যে অসুস্থাবস্থায় তার বাবা তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। কয়েকদিন চিকিৎসার পর এক পরিচিত নারীর সাথে তাকে পাঠিয়ে দেন ভারতে। এদিকে লোকজন এ নিয়ে নানা কথাবার্তা শুরু করলে মায়ার বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এক সময় লোক লজ্জায় তিনি শ্বশুরবাড়ী থেকে নিরুদ্দেশ হন।

দেশ স্বাধীন হলে মায়া দেশে ফেরেন। ঘর জামাই বাবা চলে যাওয়ায় মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজ নেন। কিন্তু কোনও সন্ধান পাননি। বাবার চিন্তায় চিন্তায় কিছুদিন পর মাও মারা যান। এর পর তিনি পুরো এতিম। এসময় নানীই ছিলেন একমাত্র ভরসা। কিন্তু কিছুদিন পর সেই নানীও মারা যান। তাঁর যে অল্প কিছু জমি ছিলো তা চলে যায় অন্যের নামে। ফলে মানুষের বাড়িতে, হোটেলে কাজ করে দু-বেলা দু-মুঠো খাবার জোটে তাঁর।

এক সময় গ্রামেরই একজনের পরামর্শে এক ছেলের সাথে (মন্দিরগাঁও গ্রামের সিকান্দর মিয়া) তার বিয়েও হয় (দ্বিতীয় বিয়ে)। কিন্তু মানুষ নানা কথা বলায় ওই স্বামীও তাঁকে ছেড়ে দেন। শুরু হয় বঞ্চনা। একসময় তিনি কাজ করতেন শ্রীমঙ্গল সাতগাঁও ষ্টেশন বাজারে খাজা গরিবে নেওয়াজ হোটেল। সে হোটেলের মালিক কাজী ফুল মিয়া নিজের ২য় স্ত্রী রেখেও তাকে ৩য় বিয়ে করেন। উদ্দেশ্য বিনা বেতনে হোটেলের কাজ করিয়ে নেয়া। ওই সময় তাঁর দুটি মেয়েও জন্ম নেয়।

কিন্তু কিছুদিন পর হোটেল ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি হয়ে পড়েন নিরুপায়। আরও কিছুদিন পর দুই সন্তানকে ছোট রেখেই তিনি মারা যান। মায়ার জীবনে আবারও নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। দুই সন্তানকে মানুষ করতে বাসা বাড়িতে, হোটেলে কাজ করতে হয়। বেশ কিছুদিন তিনি পুষ্টিতেও কাজ করেন। ঘর ভাড়া নিয়ে খেয়ে না খেয়ে মেয়ে দুটিকে বড় করেন। কষ্ট করে মেয়েদের বিয়েও দেন। কিন্তু মায়ের মতো মেয়েদেরও সংসার টিকে না। লোকজনের কটাক্ষে ছোট মেয়ে স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে তাঁর কাছে চলে আসে। আর বড় মেয়ের স্বামী মারা যাওয়ায় সেও এখন তার উপর নির্ভরশীল। মায়ার বয়স বেড়েছে সাথে সাথে বোঝাও বেড়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য
এ ব্যাপারে ষাড়েরগঞ্জ গ্রামের জানাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (তৎকালীন পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প) পশ্চিমের বাড়ির বয়বৃদ্ধ আব্দুল ছমেদ ও একই গ্রামের মখলিস মিয়া জানান- মায়া খাতুন বড় কষ্ট করে তার জীবন পরিচালনা করছে। একাত্তরে পাকবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যেতে তারা দেখেছেন। তাঁর নির্যাতনের খবর সবারই জানা।

একই গ্রামের আলকাছ মিয়া জানান- মায়ার বাবা এখানে ঘর জামাই থাকতেন। মায়াকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। এর পর মায়ার মাও মারা যান। তখন থেকেই এতিমের মতো কষ্ট করে মায়া জীবন অতিবাহিত করেন।

মায়া বর্তমান ষাড়েরগজ গ্রামে মৃত আব্দুল করিমের বাড়িতে ছোট একটি ঘর তৈরী করে দুই মেয়ে ও নাতি নাতিন নিয়ে বসবাস করছেন। মৃত আব্দুল করিমের ছেলে আব্দুছ ছমেদ জানান, তাদেরও জায়গা জমি তেমন নেই। তার ও ভাইয়ের সন্তানরা বড় হচ্ছে। জায়গাটি তাদেরও প্রয়োজন হবে। তবে মায়া খাতুন অন্যত্র কোনও ব্যবস্থা না হলে এখানে থাকতে তার কোন আপত্তি নেই।

এখন মায়া খাতুনের দাবী- তাঁর জীবনের শেষ বেলায় তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ও সরকারের দেয়া একটি ঘর পেলে অন্তত শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন।

মনোয়ারা ও সবজান বিবির গল্প
একইভাবে একাত্তরের বীর মাতা মনোয়ারার জীবনেও ঘটে এমন দুর্বিষহ ঘটনা। মনোয়ারার বিয়ে ঠিক ছিলো একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। খবর পেয়ে তার সন্ধান নিতে গিয়ে তিনি পাক সেনাদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। স্বাধীনতার অনেক পরে দ্বিতীয়বার আরেক জনের সাথে বিয়ে হলেও ওই অপবাদের কারণে বীরমাতা শিলাগুহ ও মায়া খাতুনের মতো তাকেও সন্তান নিয়ে প্রায় রাস্তায় দিন কাটাতে হয়।

রেলওয়ের পরিত্যক্ত জায়গায় থাকেন আর রাস্তায় শ্রমিকের কাজ করে দুই মেয়েকে বিয়ে দেন। কিন্তু শিলার মতো মনোয়ারারও এক মেয়ে এখন মায়ের উপর নির্ভরশীল। আজও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি নিজের কোনও জায়গা বা ঘর। তবে সরকার তাকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা উপাধি দিয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার উপাধি পেলেও ভোটার আইডি কার্ডে ভুল থাকায় গত ৪ বছর ধরে তিনি তুলতে পারছেন না তার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা।

উপরোক্ত তিন জনের মতোই ভাগ্য বিড়ম্বিত সিন্দুরখাঁনের সবজান বিবিও। স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে তাঁরও পরবর্তী জীবনের সুখ বিসর্জন দিতে হয়। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজন একজনের সাথে বিয়ে দিলেও মানুষের কৌণিক মন্তব্যের কারণে তাকে ফেলে চলে যান স্বামী। এর পর থেকে তিনিও ছায়াহীন। নিজের কোনও বাড়িঘর নেই। বোনদের বাড়িতে পালাক্রমে থেকে জীবন চলে তার।

এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার নজরুল ইসলাম জানান- শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বিকুল চক্রবর্তীর মাধ্যমে মনোয়ারা, মায়া খাতুন ও শিলা গুহের দুর্বিষহ জীবনের গল্প শুনেছি। যাচাই-বাছাই স্বাপেক্ষে মুজিববর্ষেই তাদেরকে দুই শতাংশ জমিসহ ঘর দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা করছি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *