স্বদেশ বাণী ডেস্ক: কসাই শব্দটি শুনলে স্বাভাবিকভাবে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে একজন পুরুষের ছবি। কিন্তু যদি বলা হয় কোনও নারী এই কাজ করছেন, তাহলে খানিকটা অবাক হতে হবে। অবাক হলেও সত্যি, এই কাজ করছেন দিনাজপুরের জমিলা বেগম। কসাইয়ের তকমা লাগিয়ে টানা ২০ বছর ধরে মাংস বিক্রি করছেন তিনি। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি গরু জবাই হয় কসাই জমিলার দোকানে।
জমিলা একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হলেও তার জীবনযুদ্ধটা সহজ ছিল না। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নারী উদ্যোক্তা ও নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করায় তাকে এবারে জয়ীতার সম্মাননা দেওয়ার কথা জানিয়েছে জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতর।
জমিলা দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শতগ্রাম ইউনিয়নের ঝাড়বাড়ী বাজারে মাংস বিক্রি করেন। দোকানের নাম ‘মায়ের দোয়া মাংস ভান্ডার’। বাজারের ঠিক মাঝখানে দোকান তার। মাংসের দোকানে বসেই কথা হয় জমিলা বেগমের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘১৯৮৫ সালের দিকে বগুড়া জেলার ছ’মিল বন্দর এলাকার রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। রফিকুলও পেশায় কসাই ছিলেন। কিন্তু মাদকের কবলে পড়ে তার ব্যবসায় লোকসান হতে শুরু করে। ঋণ করেও ব্যবসা আর ফেরাতে পারেননি। পরে ২০০০ সালের দিকে স্বামী ও ছেলেসহ বাবার বাড়িতে ফিরে যাই। বাড়ির পাশেই ঝাড়বাড়ী বাজারে স্বামী মাংসের দোকান দেন, আর তাকে আমি সহায়তা করতে থাকি। দোকান চালাতে আমার স্বামী বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে ঋণ নেন। একসময়ে ব্যবসার ৩ লাখ টাকা নিয়ে তিনি নিরুদ্দেশ হন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পাওয়া যায় না। পরে নিজেই দোকানের হাল ধরি, হয়ে যাই কসাই। ধীরে ধীরে ঋণের টাকা শোধ করি।’
জমিলা বেগম বলেন, ‘প্রথম দিকে এলাকার লোকজন বিষয়টি ভালো চোখে দেখেননি। অনেকেই বিভিন্ন অভিযোগ দেন, অভিযোগ যায় ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত। কিন্তু এরপরও দমে যাইনি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে ও সংসার পরিচালনাকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের মতো করেই ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকি। গরু কেনা, জবাই করা, মাংস কাটা, ওজন দিয়ে বিক্রি করা, সবই করি। আর পাশে থেকে আমাকে সহযোগিতা করে ছেলে জহুরুল হক। একপর্যায়ে এলাকার লোকজনও বিষয়টি ভালোভাবে দেখতে শুরু করেন।’
জমিলা বেগম আরও বলেন, ‘প্রতিদিন মাংস কিনতে বিভিন্ন এলাকার লোকজন ভিড় জমায় দোকানে। বর্তমানে আমার দোকানে দুইজন সহকারী আছেন, যারা মাংস কাটতে সহযোগিতা করেন। আর ছেলে জহুরুল বিভিন্ন বাজারে গিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত গরু কিনে আনে। প্রতিদিন ২ থেকে ৩টি গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করি। সোমবারে দোকান বন্ধ থাকে।’
জানা গেছে, জমিলার ‘মায়ের দোয়া মাংস ভান্ডার’ থেকে মাংস কিনতে জেলার কাহারোল, বীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, পঞ্চগড়সহ দূর-দূরান্তের ক্রেতারা আসেন। ক্রেতা ও স্থানীয়দের মতে, সততাই তার ব্যবসার বড় পুঁজি।
মাংস ক্রেতা বীরগঞ্জ ঝাড়বাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মতিউল ইসলাম বলেন, প্রতিদিনই আমিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন তার দোকানে মাংস কিনতে আসে। ভালো মাংস বিক্রি করে দেখে তার দোকানে ভিড় লেগেই থাকে।
ঝাড়বাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তাসমি আল বারী বলেন, জমিলার ব্যবসার বড় বিষয় হলো সততা। সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার ও ভালো মাংস দেওয়ায় সবাই তার কাছে আসেন মাংস কিনতে।
বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়ামিন হোসেন বলেন, ‘একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে জমিলা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সরকারিভাবে তাকে সহযোগিতার পাশাপাশি জয়ীতার পুরস্কারের জন্য তার নাম পাঠানো হবে।’
দিনাজপুর জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোর্শেদ আলী খান বলেন, ‘নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েই আমাদের কাজ। নারী-পুরুষের সমতার একজন জ্বলন্ত প্রমাণ জমিলা। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি তার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং তাকে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তার পথ চলায় সবসময় মহিলা বিষয়ক অধিদফতর পাশে থাকবে। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।
স্ব.বা/শা