প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠনের পথে সরকার

জাতীয় লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: সময়ের প্রয়োজনে সরকার প্রয়োজনীয় সুপারিশ পাওয়ার লক্ষ্যে আবারও একটি ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন’ গঠন করতে চায়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এমন প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হবে প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায়। সভা হবে ১২ ডিসেম্বর।

যথারীতি দীর্ঘ প্রস্তাবনা ও নানা সংযুক্তিপত্র উপস্থাপন করার প্রস্তুতিও নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সূত্রমতে, যদিও প্রস্তাবটি গেল অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত সভায়ও উপস্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। অবশ্য প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এটি নিয়ে মূলত আলোচনা আর নথি চালাচালি হচ্ছে দুবছর আগে থেকে। বিষয়টির সূত্রপাত করেছিলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। পরবর্তী সময়ে সেটি জোরদার করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসাবে কর্মরত।

এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব এবং বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবু আলম মো. শহিদ খান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত প্রতিটি সরকারের আমলে জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে কমিশন/কমিটি হয়েছে অনেক। কিন্তু সব কমিটির বেশির ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ এ বিষয়ে মোটাসোটা বই প্রকাশিত হয়েছে, যা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে নিশ্চয় আছে। বইগুলোয় যে ধুলাও পড়েছে, সেটি বললে ভুল বলা হবে না। মূলত সংস্কার কমিশনের নামে বিষয়টি এখন অনেকটা তামাশায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জনপ্রশাসন সংস্কারের জন্য জনবান্ধব, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক একটি জনপ্রশাসন খুবই জরুরি। এটি সময়ের দাবি। সবাই এটি চায়। তবে এর আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে যতক্ষণ রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হবে, ততক্ষণ এ ধরনের কমিশন কিংবা কমিটি অতীতের মতো কোনো কাজে আসবে না। আবারও ধুলায় ধূসরিত হবে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বই।’

প্রশাসনিক সচিব কমিটির সদস্যদের কাছে ইতোমধ্যে বিশদ প্রস্তাব সংবলিত এজেন্ডা পাঠানো হয়েছে। যার শীর্ষে রয়েছে প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনা করার বিষয়। তবে আশা করা হচ্ছে, এবার হয়তো আলোচনা হবে। প্রস্তাবের সঙ্গে এ সংক্রান্ত আগের অনেক অফিশিয়াল চিঠিপত্র সংযুক্ত করা হয়েছে। যেখানে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দুবছর আগের একটি সভার কার্যবিবরণীর আলোচনা ও সিদ্ধান্তের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ওই সভায় মূল আলোচনায় বলা হয়, দাপ্তরিক কাজে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বৃদ্ধির ফলে এবং সময়ের বিবর্তনে যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়/বিভাগ, অধিদপ্তর ও সংস্থাগুলোর কাজের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলোর কাজের পরিধি বৃদ্ধি পেলেও সে তুলনায় জনবল কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। কোনো কোনো মন্ত্রণালয়/বিভাগে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে জনবলের বিপরীতে পদ সৃষ্টি করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। অথচ দেশের জনসংখ্যা ও জিডিপি বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।

তাছাড়া প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে নৈমিত্তিক কাজের অংশ হিসাবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর মন্ত্রণালয়/বিভাগ, অধিদপ্তর ও সংস্থাগুলোর জনবল চাহিদা পর্যালোচনাক্রমে তা যুক্তিসংগতভাবে পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ কারণে জনগণের প্রত্যাশিত সেবা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে। অথচ সার্বিক প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনা করে সুষম জনবল কাঠামো গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনগণকে দ্রুত সেবা দেওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসনে সংস্কার আনা প্রয়োজন।

এতে আরও বলা হয়, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য বিদ্যমান জনবল কাঠামো সংস্কার করা দরকার। জনবলের সঙ্গে সঙ্গে যানবাহন ও অফিস সরঞ্জামাদির প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া মন্ত্রণালয়/বিভাগ, সংস্থা, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তর, দপ্তরের মধ্যে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর ও সংস্থার বেশির ভাগ কাজই চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বর্তমানে মন্ত্রণালয়/বিভাগে পাঠাতে হয়। এ কারণে ওই দপ্তরগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। অপরদিকে মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলো তাদের মূল দায়িত্ব তথা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর স্বাক্ষরিত সভার কার্যবিবরণীর সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘এই আলোচনা অনুযায়ী সেবাধর্মী ও উন্নয়নমুখী প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি কমিশন গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।’

পরবর্তী সময়ে গত বছর ২২ ডিসেম্বর এ বিষয়ে প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির জন্য দুই পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ পাঠান তৎকালীন জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। সেখানেও প্রশাসন সংস্কারের বিষয়ে নানা যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। এরপর থেকে বিষয়টি নানাভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ ওই অর্থে কিছুই হয়নি।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ করে গণমাধ্যমে কথা বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা আক্ষেপ করে যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রশাসন সংস্কারে যেসব বস্তা বস্তা সুপারিশ পড়ে আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করলেই তো মৌলিক অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাছাড়া ‘কী করিলে কী হয়’-এটা কে না জানে। এই প্রস্তাবের মধ্যে যেসব নীতি ও প্রস্তাবের কথা বলা আছে, সেগুলো আগে বাস্তবায়ন করলে সমস্যা কোথায়?’ তারা বলেন, ‘গত দুই-তিন দশকে প্রশাসনের আকার অনেক বেড়েছে। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের কোনো স্তরের জন্য প্রকৃত অর্থে কত পদ, সেটিই তো এখনো চূড়ান্ত হয়নি। শূন্যপদের বাইরে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত পদায়ন না করে দেওয়া হয় সংযুক্তি কিংবা কারও ভাগ্যে জোটে সুপারনিউমারারি নামে সৃষ্ট এক অদ্ভুত পদ। এগুলো থেকে বের হওয়ার জন্য কোনো কমিশনের সুপারিশ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।’ তাদের মতে, পদোন্নতি, পদায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান যেসব নীতিমালা ও বিধিমালা রয়েছে, সেগুলো কি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে? মনে হয় না। তাহলে ফের কমিশনের সুপারিশ দিয়ে কী হবে। আর বিকেন্দ্রীকরণ তো মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই নেই। কর্মবণ্টন নীতিমালা অনুযায়ী যার কাছে যে ফাইল নিষ্পত্তি করার কথা তা হয় না।

বাস্তবতা হলো, যে বিষয়টি উপসচিব কিংবা বড়জোর যুগ্মসচিব পর্যায়ে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, তা চলে যাচ্ছে একেবারে মন্ত্রী পর্যন্ত। আসলে অনেকে দায়িত্ব এড়াতে চান বলে এমন কৌশলের পথ বেছে নিয়েছেন। এর ফলে কাজ এগোচ্ছে না। যে নথি নিষ্পত্তি হওয়ার কথা তিন দিনে, তা লেগে যাচ্ছে ১৫ দিন। তারা বলেন, দরকার আসলে শেখ ইউসুফ হারুনের মতো কোমর সোজা করে দাঁড়ানো সচিব। এ রকম সচিব হয়তো আরও অনেকে আছেন। তবে একজনকে দিয়েই উদাহরণ দেওয়া হলো। মোদ্দা কথা, সত্য কথা সাহসের সঙ্গে কতজন বলতে পারেন-এটিই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। সারাক্ষণ আমরা যদি নিজের পদ-পদবিসহ ব্যক্তিগত স্বার্থকে বড় করে দেখি, তাহলে যত কমিশন গঠিত হোক না কেন, বাস্তবে কোনো লাভ হবে না। মাঝখানে আরও কিছু কাগজ, সময় ও অর্থ নষ্ট হবে।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব এবং বর্তমানে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসাবে কর্মরত শেখ ইউসুফ হারুনের মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে সোমবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘এটা সত্য যে আমরা অতীতে গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশগুলো হয়তো সেভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে সময় ও বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে প্রশাসন সংস্কারে অবশ্যই কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এটি তিনিও চান। কেননা, দেখেন সরকারি কর্মচারীদের আচরণবিধি সেই ১৯৭৯ সালে প্রণীত। সেখানে বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারী তার স্বার্থের প্রশ্নে কোনো এমপি কিংবা জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে ডিও লেটার আনতে পারবেন না। যদি আনেন, তাহলে সেটি অসদাচরণের অপরাধ। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে-সেটি আমরা সবাই কমবেশি জানি।’ তাই তিনি মনে করেন, ‘বাস্তবায়ন করার মানসিকতা নিয়ে আমাদের প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে।’

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *