শাহজালালে বেসামাল যাত্রীসেবা, ফ্লাইট শিডিউল লন্ডভন্ড

জাতীয় লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: রানওয়ে বন্ধ থাকায় রাতে চলাচলকারী ২০ ফ্লাইটের অতিরিক্ত চাপে দিনের বেলায় লন্ডভন্ড হয়ে পড়ছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এতে বেসামাল হয়ে পড়ছে যাত্রীসেবা। টার্মিনালে পর্যাপ্ত ট্রলি নেই। যেগুলো আছে, এর অধিকাংশই নষ্ট। কাউন্টার থাকলেও নেই পর্যাপ্ত ইমিগ্রেশন পুলিশ। একটিমাত্র মেশিনের কারণে লাগেজ স্ক্যানিংয়ে দেশে ফেরা যাত্রীদের দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। প্রতিটি বিভাগে আছে চরম জনবল সংকট। উড়োজাহাজ থেকে বেল্টে মালামাল আসতে লেগে যাচ্ছে ১ থেকে দেড় ঘণ্টার বেশি। মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রীদের দুর্ভোগ আরও চরমে। তাদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে পিসিআর টেস্টর জন্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় একসঙ্গে ৩টি ফ্লাইট নামলে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে সব ধরনের যাত্রীসেবা। দূরদেশ থেকে বিমানবন্দরে নামার পর দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এবং মালামাল নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রলি খুঁজে না পেয়ে প্রায়ই যাত্রীরা হইচই, ধাক্কাধাক্কি করছেন। যাত্রীদের নিতে আসা স্বজনকেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ১০ ডিসেম্বর থেকে রাত ১২টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত শাহজালাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের নতুন হাইস্পিড কানেকটিং ট্যাক্সিওয়ে নির্মাণকাজের জন্য আগামী ছয় মাস রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ৮ ঘণ্টা করে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকবে। এতে দিনরাতের অবশিষ্ট ১৬ ঘণ্টায় ২৪ ঘণ্টার শিডিউল ফ্লাইটের ব্যবস্থাপনা করতে হচ্ছে।

বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, রাতে যে সময়ে রানওয়ে বন্ধ থাকছে, ওই সময়ে সৌদি এয়ারলাইন্স, এমিরেটস, তার্কিশ এয়ারলাইন্স, বিমান, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ও কুয়েত এয়ারের ২০টি ফ্লাইট ওঠানামা করত। এসব ফ্লাইটের নতুন শিডিউল করা হয়েছে এখন দিনের বেলায়। এর মধ্যে বেশি ফ্লাইট পড়েছে বিকালের পর। যার কারণে পুরো দিনের বিশেষ করে বিকালের পর থেকে বিমানবন্দরে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দেয়। হযবরল অবস্থা তৈরি হয় ফ্লাইট শিডিউলের। একসঙ্গে শতশত যাত্রীর অতিরিক্ত চাপ পড়ায় হিমশিম খেতে হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে। ডিপার্চার যাত্রীদের বোডিং কার্ড ইস্যু, ইমিগ্রেশন, লাগেজ হ্যান্ডলিং, পিসিআর টেস্ট, ট্রলি সার্ভিস সব ক্ষেত্রে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। একই অবস্থায় পড়তে হয় ফিরতি ফ্লাইটের যাত্রীদেরও। সেক্ষেত্রে করোনা সার্টিফিকেট যাচাই, ইমিগ্রেশন, লাগেজ পাওয়া এবং সেই লাগেজ বহনের জন্য ট্রলি পেতে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। করোনা সার্টিফিকেট যাচাই-বাছাই কাউন্টারে জনবল কম হওয়ায় সেখানে বিশাল লাইন পড়ে যায়। সেখান থেকে বের হয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারেও দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এরপর বেল্টে এসেও ১ থেকে দেড় ঘণ্টার আগে পাওয়া যাচ্ছে না লাগেজ। লাগেজ পাওয়া গেলেও সেই লাগেজ বহন করার জন্য পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত ট্রলি।

বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে শাহজালালে মোট ২ হাজার ট্রলি রয়েছে। এর মধ্যে ৬শ অচল হয়ে পড়ে আছে। বাকি ১৪শও চলছে খুুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তবে ট্রলি নিয়ে সম্প্রতি একটি সিন্ডিকেট বড় ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর নেপথ্যে কাজ করেছে ক্রয় বাণিজ্য। জানা যায়, এই সিন্ডিকেট ট্রলি সার্ভিসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কতিপয় অসাধু কর্মীকে মাসোহারা দিয়ে সচল ট্রলিগুলোকে বিমানবন্দরের বিভিন্ন জায়গায় ফেলে রেখেছিল। যাত্রীরা ট্রলি করে মালামাল নিয়ে টার্মিনালের বাইরে গেলে ট্রলিম্যানরা সেগুলো ফ্লাইট নামার সময় যথাযথ জায়গায় নিয়ে আসত না। উলটো নানা জায়গায় ফেলে রাখত। যে কারণে কোনো ফ্লাইট অবতরণের পর চরম ট্রলি সংকট দেখা দিত।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ উল আহসান যুগান্তরকে বলেন, রাতে ফ্লাইট বন্ধ থাকার কারণে উড্ডয়ন-অবতরণ মিলে প্রায় ২০টি ফ্লাইটের জন্য দিনের বেলায় নতুন শিডিউল করতে হয়েছে। প্রথমদিকে জনবল সংকটসহ নানা কারণে যাত্রীদের কিছুটা দুর্ভোগ হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপের কারণে এখন আস্তে আস্তে সবকিছু স্বভাবিক হয়ে গেছে বলেও তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, রাতে ৮ ঘণ্টা ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকায় যদি কোনো উড়োজাহাজকে জরুরি অবতরণ করতে হয়, তাহলে সিলেটের ওসমানী ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এজন্য ওই দুই বিমানবন্দরে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। ট্রলি সংকটের পাশাপাশি ইমিগ্রেশন কাউন্টারগুলোয় দীর্ঘ লাইন পড়ে যায় এখন। জানা যায়, বিমানবন্দরে বর্তমানে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সংখ্যা অনেক হলেও সেখানে প্রয়োজনীয় জনবল নেই। ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না হওয়ায় ৯ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১০টার পর শাহজালাল বিমানবন্দর ছাড়তে পারেনি কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। সেদিন অনেক কাউন্টারেই ইমিগ্রেশন পুলিশের কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি। একই অবস্থা এখন প্রতিদিনই হচ্ছে। ১০ ডিসেম্বরের পর এখন এই লাইন আরও দীর্ঘ হচ্ছে। ফ্লাইটের সময় শেষ হয়ে গেলেও অনেক যাত্রীকে দেখা যাচ্ছে ইমিগ্রেশনের দীর্ঘ লাইনে। বাধ্য হয়ে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষকে মাইকিং করে সেসব যাত্রীকে ডেকে ডেকে ইমিগ্রেশন করাতে হয়। কয়েকদিন আগে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ের ২ ঘণ্টা পর ছাড়তে হয়েছে যাত্রীদের ইমিগ্রেশন করাতে দেরি হওয়ায়। শুধু ইমিগ্রেশন নয়, সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা কাউন্টারেও যাত্রীদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে লাগেজ, হ্যান্ডব্যাগ স্ক্যানিং ও বডি স্ক্যানিং করাতে হয়। জানা যায়, আগে ফ্লাইট কম থাকার সময় যে জনবল দিয়ে এসব কাজ করানো হতো, এখন ফ্লাইট বাড়ার পরও আগের জনবল দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে। একাধিক বিদেশি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছেন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে তারা যথাযথ সময়ে ফ্লাইট ছাড়তে না পারলেও তাদেরকে বিপুল অঙ্কের টাকা জরিমানা দিতে হচ্ছে। জানা যায়, এক ঘণ্টা ফ্লাইট ছাড়তে দেরি হলে একটি এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানকে কমপক্ষে ২ থেকে ৫ হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হয়। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, বিদেশগামীদের জন্য বিমানবন্দরের বহির্গমন টার্মিনালে মোট তিনটি গেটে ইমিগ্রেশন কাউন্টার রয়েছে। রাত ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিমানবন্দরে মোট চার হাজার মধ্যপ্রাচ্যের যাত্রী চলাচল করেন। এই তিনটি ইমিগ্রেশন গেট চার হাজার যাত্রীর জন্য পর্যাপ্ত নয়। মাঝেমধ্যে দুটি গেটের কাউন্টারে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম চলে। জনবল না থাকায় একটি বন্ধ থাকে। যে দুটি গেট খোলা, ওই দুটির অনেক কাউন্টারেও ইমিগ্রেশন অফিসার থাকেন না। সব মিলে হযবরল অবস্থা।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *