জুতার কষে বশ মেনেছে অবুঝ-জীবন

জাতীয়

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: থাকা-খাওয়ার কোনো শৃঙ্খলা নেই। গোসলের সময় নেই। জীবন নিয়ে স্বপ্ন কিংবা আকাঙ্ক্ষা নেই। সাধ নেই, সাধনাও নেই, ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই। ওদের রোগও নেই, চিকিৎসাও নেই। আছে কেবল একটি চাহিদা। যার নাম ওদের ভাষায় গাম, জুতার কষ বা ড্যান্ডি। সেই কষই বশ করে নিয়েছে অগণিত শিশুর জীবন। ড্যান্ডির নেশায় জড়িয়ে পড়া শিশুদের জীবনের গল্পটা বেদনাময়।

রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে সহজেই দৃশ্যটি চোখে পড়ে। পথশিশুদের এক হাতে থাকে ভাঙারির বস্তা, অন্য হাতে পলিথিন। পলিথিন মুখে নিয়ে ওরা শ্বাস নেয়। এটিই ড্যান্ডি। এই মাদকদ্রব্য পথশিশুদের গ্রাস করে নিচ্ছে।

মূলত সাইকেল বা রিকশার টায়ার-টিউব কিংবা জুতা সারাতে যে আঠা ব্যবহার হয় তাই ড্যান্ডি। এর প্রকৃত নাম ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ বা ড্যান্ড্রাইট আঠা। এতে অ্যাডহেসিভে টলুইন জাতীয় তরল উপাদান থাকে। টলুইনসমৃদ্ধ এই অ্যাডহেসিভ মূলত ছোটখাটো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, ডিভাইস, চামড়া ও প্লাস্টিকের পণ্য জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। অ্যাডহেসিভের ঘ্রাণ মানুষের মস্তিষ্কে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে সক্ষম। ক্ষণস্থায়ী সেই অনুভূতি থেকে তৈরি হয় আসক্তি। যে আসক্তি পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়।

১৯৮০ সালের আগ অবধি ড্যান্ড্রাইট জাতীয় আঠা তৈরির কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ছিল না। কাজের প্রয়োজনে এসব দ্রব্য ভারত থেকে আমদানি করা হতো। ১৯৮১-৮২ সালের দিকে এটি বাংলাদেশে তৈরি হতে থাকে। বর্তমানে দেশে একাধিক কোম্পানির বিভিন্ন নামে এ ধরনের পণ্য বাজারে আছে। বাংলাদেশের পথশিশুরা ড্যান্ড্রাইট জাতীয় আঠা পলিথিনের মধ্যে ভরে সেখান থেকে শ্বাস ফুসফুসে টেনে নেয়। প্রথমে পলিথিনে আঠা ঢুকিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ ঝাঁকানো হয়। পলিথিনের ব্যাগ বাতাস দিয়ে ফুলালে সৃষ্টি হয় তীব্র গন্ধযুক্ত গ্যাস। এরপর পলিথিন থেকে সেই গ্যাস নাক ও মুখ দিয়ে টেনে নেয় তারা; যা চলে যায় দেহে। পলিথিন, প্লাস্টিক ছাড়াও জামাকাপড়ে ড্যান্ডির গাম লাগিয়ে নাক দিয়ে টানে তারা। এই গ্যাস ফুসফুসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর নেশাময় হয়।

রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সূত্র বলছে, এই নেশার ফলে অ্যাডহেসিভ শরীরের ভেতরে বাসা বাঁধে। শরীরের যেসব জায়গায় অ্যাডহেসিভ পৌঁছায়, সে জায়গার কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। আর কোষ নষ্ট হওয়ার কারণে মস্তিষ্কেও অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এছাড়াও, এই আঠা নাকের ভেতরে ক্ষত সৃষ্টি করে। এ ধরনের মাদকে শারীরিক এবং মানসিক উভয় ধরনের প্রভাব ফেলে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া হয় আরো ভয়াবহ। এছাড়াও এই মাদক সেবনের কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে হঠাৎ করে উত্তেজিত হওয়া, রাতে বিছানায় প্রস্রাব করার মতো বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের আশ্রয়হীন ভাসমান শিশুদের মধ্যে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ ড্যান্ডিতে আসক্ত। এছাড়াও বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের আরেকটি গবেষণা জানাচ্ছে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। তাদের ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ শিশু ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট, ৮ শতাংশ শিশু ইনজেকশনে আসক্ত। ঢাকা শহরের পথশিশুরা সাধারণত সিগারেট, গাঁজা, ড্যান্ডি ও পেট্রল শুঁকে নেশা করে। তবে পথশিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ড্যান্ডির নেশায়৷

ড্যান্ডি সেবনে অভ্যস্ত শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ড্যান্ডি সেবনে ক্ষুধামন্দা তৈরি হয়। ঝিমুনি আসে, রাস্তাঘাটে, স্টেশনে কিংবা ফুটপাতে যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়া যায়। শিশুরা ক্ষুধার জ্বালা ভুলতে ও ভালো করে ঘুমানোর আশায় ড্যান্ডি খায়। ঘুমিয়ে যেতে পারলে তখন আর ক্ষুধার কথা মনে থাকে না। এ ছাড়াও একাকীত্বের কষ্ট বা সঙ্গ দোষে এই ধরনের মাদকে অভ্যস্ত হচ্ছে ভাসমান শিশুরা। একাধিক ড্যান্ডি আসক্ত শিশুদের ভাষ্য, দিনে একবার ড্যান্ডি খেলে সারাদিন কারো কথা মনে পড়ে না।

শুধু এসব কারণেই নয়, শহরের রাস্তায় ভাসমান অনেক পরিবারের সবাই এ ধরনের নেশা করে। এতে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের থেকেও নেশায় আকৃষ্ট হয়ে ওঠে ঐসব পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা। রাজধানীর মোটামুটি সব এলাকায় টোকাইয়ের কাজ করা অধিকাংশ পথশিশুর হাতে দেখা মিলবে ড্যান্ডি। এর মধ্যে সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, কমলাপুর, মুগদা, মতিঝিল, মহাখালী, কারওয়ান বাজার, গাবতলী, আমিনবাজার, টঙ্গী এলাকায় এই দৃশ্য বেশি দেখা যায়। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্থান রয়েছে, যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। তবে সরেজমিনে জিজ্ঞাসাবাদে শিশুদের দেওয়া তথ্য বলছে, টঙ্গীর কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছে, যারা নানা জায়গায় প্রতিদিন ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় থাকে। তাদের নামও শিশুরা জানে না, দেখেই চিনে ফেলে। তাদের কাছ থেকেই পথশিশুরা এসব সংগ্রহ করে। তাছাড়া হার্ডওয়ারের দোকান থেকেও এই গাম খুব সহজেই কেনা যায়।

পথশিশুদের মধ্যে ড্যান্ডি বিস্তারের অন্যতম কারণ এর সস্তা দাম। রাজধানীর এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে টোকাইয়ের কাজ করে পথশিশু মো. ইমন (ছদ্মনাম)। স্টেশনে থাকা অন্যসব শিশুদের মাধ্যমে জানা গেল, নিয়মিত ড্যান্ডি গ্রহণ করে সে। ড্যান্ডি সেবনের বিষয়টি স্বীকার করে শিশুটি জানায়, ড্যান্ডির দাম কম, সহজে পাওয়া যায়, কিনতে গেলে কেউ সন্দেহও করে না। সস্তায় এই জিনিস কেনা যায়। তিন-চারজন মাত্র ২০ টাকা করে দিলেই ড্যান্ডি কেনা যায়।

ইমন জানায়, ছোট সাইজের গাম ৫০ টাকায় সংগ্রহ করা যায়। আবার ১০০ টাকায়ও কেনা যায়, যা একটি কিনে দুই থেকে তিনজনে ভাগ করে নিলেই হয়। এতে ভাগে পড়ে ৩০-৫০ টাকা। ড্যান্ডি আসক্তরা পুরো কৌটা কিংবা টিউব কেনে না। তারা যে যার প্রয়োজন অনুপাতে ইলেকট্রনিক পণ্য মেরামতের দোকান বা জুতা মেরামতকারীদের (মুচি) কাছ থেকে অল্প করে সংগ্রহ করে।

আবার সঙ্গ দোষেও সৃষ্টি হয় এই আসক্তি। রাব্বি (ছদ্মনাম) তেমনই একজন। ছয় মাস আগে ঢাকায় এসেছে সে। গ্রামে থাকা অবস্থায় নেশার কিছুই বুঝত না। আসার পর দেখল স্টেশনে তার সঙ্গে থাকা শিশুরা এটি খায়। দেখে দেখে তারও ইচ্ছে জাগে। সেই থেকে শুরু। এখন চলছে হরদম। রাব্বি বলে, আগে বন্ধুরা খেত, ওদের সঙ্গে চলতে চলতে আমিও খাওয়া শিখছি। ছয় মাস ধরে খাচ্ছি। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। না খেতে পারলে ভালো লাগে না।

বেসরকারি সেচ্ছাসেবী সংগঠন নাগরিক অধিকারের কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট সায়মুল ইসলাম রাব্বি বলেন, এমনিতেই পথশিশুরা অসহায়, ওদের জীবনযুদ্ধ আমাদের মতো নয়। মায়ের স্নেহ, বাবার আদর জোটে না। স্বাভাবিক জীবনযাপনে মেলামেশার অধিকার নেই। ফলে এরা অপরাধ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। ধ্বংসাত্মক কাজে আগ্রহী ও নেতিবাচক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ওপর যেকোনো নেশায় আসক্ততা পথশিশুদের আরো অভাবী করে তোলে। এই অর্থাভাব তাদেরকে নানা রকম, চুরি-ছিনতাইয়ের পথে নিয়ে যায়। পাশাপাশি মেয়ে পথশিশুরা যৌনকর্মীর পেশায় জড়িয়ে যায়।

সায়মুল ইসলাম রাব্বি বলেন, আসক্ত পথশিশুরা নানা রকম চোরাচালানসহ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। মাদকের বাহক হিসেবে কাজের সুযোগ পায়। দেশে মাদকের বাহক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ২১ শতাংশ পথশিশু। পথশিশু সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশুরা যাতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ, শারীরিক, যৌন, মাদক, হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আর যারা এগুলো বিক্রি করছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে৷ যারা পথশিশুদের মাদকের বাহক হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর জোট- স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের (স্ক্যান) সভাপতি জাহাঙ্গীর নাকের বলেন, বাংলাদেশে পথশিশুদের ঘিরে যে প্রকল্পগুলো গৃহীত হয়, তার অধিকাংশই হয় খুব সীমিত মেয়াদের। যা মাত্র কয়েক মাসব্যাপীও হয়ে থাকে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে কার্যক্রমও শেষ। শিশুদের উন্নয়নে দীর্ঘস্থায়ী চিন্তা করতে হবে। পুনর্বাসন, লেখাপড়া শেখানো, ভোকেশনাল ট্রেনিং দেওয়াসহ শিশুদের মূলধারায় যুক্ত করতে কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

তিনি বলেন, শহরকেন্দ্রিক একাধিক চক্র রয়েছে, যারা পথশিশুদের মাদকের বাহক হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়াও ভাঙারি ব্যবসায়ীরা তাদের চুরিসহ নানা অপকর্মে ব্যবহার করে। এসব ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ দরকার। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী পর্যবেক্ষক দল দরকার। যাতে শিশু বিষয়ক সব পরিকল্পনা গ্রহণ, রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সহজ হয়।

স্ব.বা/রু

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *