‘ভাইয়ের লাশটা পেলে কবর দিতাম’

রাজশাহী লীড

স্টাফ রিপোর্টার : ‘ভাইয়ের লাশটা পেলে কবর দিতাম’ তখন সন্ধ্যা আসন্ন, সূর্য ডুবু-ডুবু। পদ্মার বাঁধে চেয়ার পেতে বসে নদীতে অপলক তাকিয়ে আছেন মাঝি বাইতুল্লাহ। রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) পদ্মায় ডুবে যায় নৌকার মাঝি এই বাইতুল্লাহ। বাইতুল্লাহর ৭০ বছরের জীবনে একবারও ঘটেনি নৌকা ডুবির ঘটনা। এমন ঘটনায় হতবাক বাইতুল্লাহ নিজেও।

রাজশাহীর মহানগরীর সাতবাড়িয়া এলাকার পদ্মায় নদীতে নৌকা ডুবির ঘটনায় ২৫ জন প্রাণে বেঁচে গেলেও এক সপ্তা ধরে নিখোঁজ রয়েছেন- সাদেক, নজু ও নবী। তারা সবাই কৃষি শ্রমিক। পদ্মার চরে ১০ নম্বর এলাকায় পতিত জমিতে মাশকলাইয়ের বীজ বপনের উদ্দ্যেশে ঘটনার দিন সকাল ৬টার দিকে রেওনা হয় সাতবাড়িয়া এলাকা থেকে। নৌকা কিছু দূর যেতেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে অন্যদেও উদ্ধার করা গেলেও তিনজন নিখোঁজ হন।

এমন মর্মান্তিক ঘটনায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের বাড়িতে স্বজনদের শোকের মাতন থামছে না। নিখোঁজ নজু ও সাদেকের বাড়ি পাশাপাশি। শনিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে নজুর বাড়িতে গিয়ে সাদেকের স্বজনদের আহাজারি শোনা যায়। স্বজনরা ধরেই নিয়েছেন নিখোঁজ তিনজনই মারা গেছেন। তাই স্বজনদের আশা, শেষ দেখা দেখে দাফন করার।

এদিন বিকেলে পদ্মা পাড়েই দেখা হয় মাঝি বাইতুল্লাহর সাথে। এসময় নৌকা ডুবির ঘটনার বর্ণনা দেন এই মাঝি। বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘আল্লাহর ৩০দিন আমি ১০ নম্বর (পদ্মার চর) যায়, শুধু শুক্রবার ছ্যাড়া (ছাড়া)। প্রতিদিন বাড়ির সামনে থ্যাকি (থেকে) লা (নৌকা) ছেড়ি (ছাড়ি)। কোনোদিন লোক (যাত্রী) হয়, আবার কোনো দিন ফাঁকা ফাঁকা যায়।

ঘটনার দিন আগেই থ্যাকিই (থেকে) ম্যালা (অনেক) লোক দ্যাড়ি (দাঁড়িয়ে) আছে। লা-এ (নৌকা) উঠবে বুলি (বলে)। সবার পাড়াপাড়ি; মাশকালাই বুনবে (জমিতে মাশকলায়ের বীজ বপন করা)। অনেককে নিশোদ (নিষেধ) করতে করতে উঠি (উঠে) পড়লো লা-এ (নৌকায়)। লা-এ (নৌকা) একজন, দু’জন করি (করে) ২৭ জন উঠিছে (উঠেছে)।

ক’জনকে রাগ করি (করে) থুঁ (রেখে) গেনু (গেছি)। অনেকের মাশকালাই এই পাড়েই থ্যাকি (থেকে) গেলো। লা-এ (নৌকা) ছেড়ার সুমাতে (ছাড়ার সময়ে) গাংঙ্গে (নদীতে) আফাল (ঢেউ) ছিলো না। মিডিল চরের (মাঝের চর) কাছাকাছি গেছি। তখন ফিরফিরি হাওয়া (বাতাস) উঠি (উঠে) ছিলো। ইকটু (একটু) বাদে (পরে) গাংঙ্গে আফাল (নদীতে ঢেউ) উঠলো।

আমি কয়েকজনকে পানিতে ন্যামি (নেমে) লা খানকে (নৌকাটা কে) চ্যারি (চেড়ে) ধরতে বুলনু (বল্লাম)। কিন্তু কেউ নামলো না।

এসুমাতে (এমন সময়) আমার লাতি (নাতি) ফারুক ও নাজু (নিখেঁজ) পানি ছেকছিলো (নৌকার পানি গামলা দিয়ে সেচা)। হঠাৎ করি (করে) দুই পাশ থ্যাকি (থেকে) পানি লা-এ (নৌকায়) উঠি (উঠে) গেলে। তখন সবাই দিক বিদিক (যার যেদিকে ইচ্ছা) লাফ দিলো। আর লা (নৌকা) তলা (ডুবে) গেলো। সাবাই হাবুডুবু খ্যাচে (খাচ্ছে)। এরই মধ্যে দুখিন (দুইটা নৌকা) এ্যাশি আমার লা-র (নৌকার) মানুষ জনকে তুলি (তুলে) লিলো (নিলো)। লা (নৌকা) দুখিন না আসলে আরো সর্বনাশ হয়ে য্যাতো। লা-তে

(নৌকায়) উঠার পরে দেখি ওরা (নিখোঁজ ব্যক্তিরা) নাই। তার পরে জানাজানি হলো। সবাই কান্নাকাটি শুরু করলো গাঙ্গের (নদীর) ধারে এ্যাসি (এসে)। এই দিন আরো দুখিন লা (নৌকা) ডুবিছে (ডুবেছে)। দুইটা সাতবাড়িয়া আর একটা তালাইমারীতে।’

বাইতুল্লাহ মাঝির কথার মাঝে তার স্ত্রী আপসোস করে বলেন, ‘লোকে (মানুষ) আমার লা (নৌকা) ডুবি (ডুবিয়ে) দিছে (দিয়েছে)। লোকগিলি (মানুষগুলো) চ্যাপি (চেপে) উঠি (উঠে) গেলো। একজনও ন্যামলো না (নামলোনা)। হওরে (তাদের বা যাত্রীদের) কারণেই আমার লা-খান (নৌকাটা) ডুবি (ডুবে) গ্যাছে (গেছে)। ওরা (অতিরিক্ত যাত্রী) না উঠলে লা-খান (নৌকাটা) ডুবতো না। আমি কত দেখিছি (দেখেছি) লা (নৌকা) ডুবি (ডুবে) যাওয়ার পরে আবার ভ্যাসি (ভেসে) উঠিছে। কিন্তু আমার লা-খান (নৌকাটা) পানু না (পেলাম না)।’

পদ্মায় নিখোঁজ নজুর ছেলে শামিম জানায়, ‘আমরাও অনেক খুঁজেছি, পাইনি। আমার মা, ভাই-বোনেরা নদীর ধারে গিয়ে কান্না করছে প্রতিদিন। বাড়িতেও স্বজনরাও এসে কান্না করছে। ঘটনার দিন থেকে বাড়িতে শোকের মাতন চলছে। ফায়ার সার্ভিসের পরে আমিও খুঁজেছি; কিন্তু আব্বাকে (নজু) পাইনি। নিখোঁজের এক সপ্তা হতে গেলো। আমরা ধরেই নিয়েছি; তিনি আর বেঁচে নেই। আমরা চাচ্ছি আব্বার দেহটা পেলে কবর দেব।’

শামিমদের পাশেই আরেক নিখোঁজ সাদেকের বাড়ি। সাদেকের বোন ময়না বেগম জানান, ‘আমারে (আমাদের) ৮ বোনের এক ভাই সাদেক। মা-বাবা ও বোনেরা অনেক ভালোবাস তো ভাইকে। আমরা ভালো বেসেছি। কি আর বুলবো, আল্লাহর ভালোতেই ভালো। ভাইয়ের লাশটা পেলে কবর দিতাম।’

স্ব.বা/ম

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *