ছাত্রলীগের নেতৃত্ব: প্রাধান্য ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন

জাতীয় লীড

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন ৬ ডিসেম্বর। ৩০তম এ সম্মেলন ঘিরে পদ-পদবি নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে যেতে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পায় কিংবা কোন যোগ্যতা আমলে নেওয়া হয় তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। সম্মেলনের সময় ঘনিয়ে এলে ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে এসব বিষয়। ‘আঞ্চলিকতা’ ও ‘সিন্ডিকেট’-এ নেতৃত্ব নির্বাচন ঘুরপাক খাচ্ছে বলে অভিযোগ। যদিও ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র নেতারা বলছেন, সংগঠনকে কে ধরে রাখতে পারবে কিংবা তার নেতৃত্বগুণ কতটা তা প্রাধান্য দিয়েই নেতা নির্বাচন করা হয়। আঞ্চলিকতার সুযোগ নেই।

ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশী বর্তমান সহ-সভাপতি সোহান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সম্মেলন এলেই কারা ছাত্রলীগের নতুন দায়িত্বে আসবে তার আলোচনা শুরু হয়। যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য কোনো অঞ্চল দেখা উচিত নয়। এতে অনেক যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব বাদ পড়ে। এছাড়া বয়স কত হবে তা নিয়ে যে আলোচনা হয় সেটাও আসতো না যদি গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নিয়মিত সম্মেলন হতো।’

তবে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকা কিংবা সম্মেলনের আগে তেমন আলোচনায় না থেকেও মেহেদী হাসান মোল্লা, ওমর শরীফ, এস এম জাকির হোসেন, রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনসহ অনেক নেতাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিতে শীর্ষ পদের দায়িত্ব পেয়েছেন।

গত চার দশকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির শীর্ষ দুই পদে দায়িত্ব পালনকারীদের বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৮১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ৪১ বছরে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি দুই বছর ও ইউনিট কমিটি এক বছর মেয়াদি হওয়ায় যেখানে ১২০ জন দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু শীর্ষ দুই পদসহ আহ্বায়ক হিসেবে ৫১ জন দায়িত্ব পালন করেছেন এ সময়ে। এর মধ্যে বরিশাল আর ফরিদপুর অঞ্চল থেকেই শীর্ষ দুই পদে ছিলেন ২৪ জন। বাকি ২৭ জন অন্য অঞ্চল থেকে দায়িত্ব পান। কোনো কোনো অঞ্চল থেকে শীর্ষপদে আসীন হতে পারেননি কেউ। ফলে নেতৃত্ব নির্বাচনে প্রাধান্য ও যোগ্যতা আসলেই কী সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি
১৯৮১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ৪১ বছরে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন-খ ম জাহাঙ্গীর (১৯৮১-১৯৮৩), আব্দুল মান্নান-জাহাঙ্গীর কবির নানক (১৯৮৩-১৯৮৫), সুলতান মুহাম্মদ মনসুর-আব্দুর রহমান (১৯৮৬-১৯৮৮), হাবিবুর রহমান-অসীম কুমার উকিল (১৯৮৮-১৯৯২), মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী-ইকবালুর রহিম (১৯৯২-১৯৯৪), এ কে এম এনামুল হক শামীম-ইসহাক আলী খান পান্না (১৯৯৪-১৯৯৮), বাহাদুর বেপারি-অজয় কর খোকন (১৯৯৮-২০০২), লিয়াকত শিকদার-নজরুল ইসলাম বাবু (২০০২-২০০৬), মাহমুদ হাসান রিপন-মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন (২০০৬-২০১১), এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ-সিদ্দিকী নাজমুল আলম (২০১১-২০১৫), সাইফুর রহমান সোহাগ-এস এম জাকির হোসেন (২০১৫-২০১৮), রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন-গোলাম রাব্বানী (২০১৮-২০১৯), আল-নাহিয়ান খান জয়-লেখক ভট্টাচার্য (২০১৯- ২০২২)। এই সময়ে যে ২৭ জন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছয়জন ফরিদপুর অঞ্চলের। এরপরই রয়েছে বরিশাল অঞ্চলের চারজন, ময়মনসিংহ অঞ্চলের তিনজন, রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের দুই বিভাগের পাঁচজন। আর চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও ঢাকা অঞ্চলের মাত্র দুজন করে আটজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি
ছাত্র রাজনীতির আঁতুড়ঘর খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতেও একই চিত্র। গত ৪১ বছরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ইউনিটগুলোতে এক বছর পরপর কমিটি হলে ৪১টি কমিটি হওয়ার কথা, সেখানে হয়েছে মাত্র ১২টি। ১৯৮১ সালের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন খলিলুর রহমান মোহন-আতাউর রহমান ডিউক (১৯৮১-১৯৮৩), আহ্বায়ক মকবুল হোসেন খান (১৯৮৩-১৯৮৫), মনিরুজ্জামান বাদল-মমতাজ উদ্দিন মেহেদী (১৯৮৬-১৯৮৮), গোলাম মোস্তফা সুজন-কামরুজ্জামান আনসারী (১৯৮৮-১৯৯২), খিজির হায়াত লিজু-পংকজ দেবনাথ (১৯৯২-১৯৯৪), বাহাদুর বেপারি-আবদুল ওয়াদুদ খোকন (১৯৯৪-১৯৯৮), সাজ্জাদ হোসেন/বেগ শাহীন জাহান (ভারপ্রাপ্ত) এ কে এম আজিম (১৯৯৮-২০০২), দেলোয়ার হোসেন-হেমায়েত উদ্দিন খান হিমু (২০০২-২০০৬), শেখ সোহেল রানা টিপু-সাজ্জাদ সাকিব বাদশা (২০০৬-২০১১), মেহেদী হাসান মোল্লা-ওমর শরীফ (২০১১-২০১৫), আবিদ আল হাসান-মোতাহার হোসেন প্রিন্স (২০১৫-২০১৮), সনজিত চন্দ্র দাস-সাদ্দাম হোসেন (২০১৮-২০২২)।

ছাত্র রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিটটিতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন মাত্র ২৪ জন। এই ২৪ জনের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি বরিশাল অঞ্চলের আটজন। এরপরই ফরিদপুর অঞ্চলের ছয়জন, ঢাকা অঞ্চলের চারজন, খুলনা অঞ্চলের তিনজন, রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের দুই বিভাগের একজন, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন করে। তবে এখানে সিলেট অঞ্চলের একজনও দায়িত্ব পায়নি।

আলোচনায় থাকেন যারা
ছাত্রলীগের সম্মেলনের ঘোষণা এলেই বরিশাল, ফরিদপুর যেমন সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকে তেমনি একেবারে কম আলোচনায় থাকে বৃহত্তর ঢাকা ও সিলেট। বিভিন্ন সময়ে যেসব অঞ্চল থেকে বেশি শীর্ষ পদ পেয়েছে সম্মেলন এলে সেসব অঞ্চলের নেতারাই আলোচনায় থাকেন। এবারের সম্মেলনেও আলোচনায় আছেন ফরিদপুর-বরিশাল অঞ্চলের এক ডজন পদপ্রত্যাশী নেতা। অঞ্চলভিত্তিক আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছেই তদবির করেন পদপ্রত্যাশীরা। ফলে আদর্শের চর্চা, যোগ্যতা ও নেতৃত্বের দক্ষতায় আলোচনায় থাকলেও অন্য অঞ্চলের পদপ্রত্যাশীরা শেষ দৌড়ে টিকে থাকেন না।

ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি মাজহারুল ইসলাম শামীম জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনে অঞ্চল কোনো গঠনতান্ত্রিক বিষয় নয়। তারপরও জাতীয় রাজনীতিতে ফরিদপুর কিংবা বরিশাল অঞ্চলের নেতাদের ভূমিকা বেশি হওয়ায় সেসব অঞ্চলের ছাত্রনেতারাও সম্মেলন এলে আলোচনায় থাকেন। এটা হওয়া উচিত নয়। নেতৃত্ব নির্বাচনে আদর্শিক চিন্তা, যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখা উচিত। যেসব অঞ্চলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংকট রয়েছে সেসব অঞ্চল থেকে নেতা হওয়া দরকার।

নেতৃত্ব নির্বাচনে গঠনতন্ত্রের প্রাধান্য কম
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনে গঠনতন্ত্রের প্রাধান্য প্রায়ই মানা হয় না। ফলে সংগঠনটির গঠনতন্ত্রের ৫ ধারায় নেতৃত্ব নির্বাচনে বয়স ২৭ বছরের কথা বলা থাকলেও সম্মেলন এলে ২৭ ঊর্ধ্ব বয়সীরাও পদপ্রত্যাশী থাকেন। এদিকে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনে সংগঠনটির সাংগঠনিক অভিভাবক আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনে ২৯ বছর বয়স নির্ধারণের ঘোষণা দেন। ফলে আগামী ৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলনে বয়স কত হবে সেটি নিয়েই বেশি আলোচনা পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে।

নিয়মিত নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনেও প্রাধান্য থাকে না ছাত্রলীগে। সংগঠনটির গঠনতন্ত্রের ১১ ধারায় কেন্দ্রীয় কমিটি দুই বছর ও বিশেষ বা জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ধিত সভায় প্রতিটি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সদস্যদের সম্মতিতে তিন মাস বাড়ানোর নিয়ম থাকলেও কমিটির মেয়াদ অনেকটা অনির্দিষ্ট। দুই বছরের কমিটির অধিকাংশই চলেছে তিন থেকে পাঁচ বছর। গত ৪১ বছরে নিয়ম অনুযায়ী দুই বছর পর কমিটি হলে যেখানে ২০টি কমিটি হওয়ার কথা সেখানে হয়েছে মাত্র ১২টি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে ৪০ জনের স্থলে নেতৃত্ব পেয়েছেন মাত্র ২৭ জন। এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিও নিয়মিত হয়নি। ৪১ বছরে ইউনিটটির নিয়মিত কমিটি হলে যেখানে ৮২ জন নেতা হওয়ার কথা সেখানে হয়েছেন মাত্র ২৪ জন।

যা বলছেন ছাত্রলীগের অভিভাবকরা
ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজ্জাম্মেল হক। সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই এই চার নেতার কাছে নানান তদবির ও শীর্ষ পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন পদপ্রত্যাশী নেতারা। তাই ছাত্রলীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলনে এই চার নেতার নিজ নিজ অঞ্চলের পদপ্রত্যাশী ছাত্রলীগ নেতাদের পাশাপাশি অন্য অঞ্চলের নেতারাও দৌড়ঝাঁপ করছেন।

এবারের নেতৃত্ব নির্বাচনে যোগ্যতা ও কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজ্জাম্মেল হক নিউজকে বলেন, করোনার কারণে বয়সের বিষয়টি বিবেচনায় আসতে পারে। এটা আলোচনা হয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের সভাপতি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। তাই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অনেকের বয়স না থাকলেও পদপ্রত্যাশী। আমরা জানি ছাত্রলীগের কারা কোথায় কীভাবে কাজ করছে। ছাত্রদের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব আসবে।

ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনে অঞ্চলের প্রাধান্যের বিষয়ে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ছাত্ররাজনীতি বিস্তারের জন্য অঞ্চল ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচনে বাধা নয়। ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের ছেলেরা যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে মাঠে থাকে, কাজ করে এবং বেশি বেশি সমর্থক থাকে সেখানে তাকে বিবেচনায় আনতে হয়। এটা আঞ্চলিকতা বা ছাত্রলীগে আঞ্চলিকতার কোনো সুযোগ নেই। বিবেচনাটা করা হয় সাংগঠনিকভাবে কে ছাত্রলীগকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিয়ে ছাত্র সমাজের কাছে জনপ্রিয় করতে পারবে। কার বাড়ি কোথায় এটা বিবেচনা করা হয় না।

স্ব.বা/রু

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *