ভোটের পরেও আলোচনায় ‘নিষেধাজ্ঞা’

বিশেষ সংবাদ লীড

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দায়িত্ব নিয়েছে নতুন সরকার। রাশিয়া, চীন, ভারতসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নতুন সরকারকে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন জানিয়েছেন। ব্যতিক্রম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রপ্রধানরা এখনো নীরব। নেতিবাচক পর্যবেক্ষণও দিয়েছে ভোটের পর। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিষেধাজ্ঞার গুঞ্জন নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে কূটনীতিকদের।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে ফের ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের পর ১০ জানুয়ারি শপথ নেন নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। এর একদিন পরই রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শপথ নেন নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা।

এর আগে-পরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা। ভারত, রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা দিয়েছেন অভিনন্দন বার্তা। তবে অভিনন্দনের তালিকায় ছিল না যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাসহ কিছু দেশ।

কূটনীতিকরা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনী অনুসন্ধানী মিশন। এই প্রতিনিধি দল মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেওয়ার পর ইইউর অবস্থান স্পষ্ট হবে। যুক্তরাষ্ট্রও এখন সে মূল্যায়ন করছে। ফলে এখনই শঙ্কা কেটে গেছে বলার সুযোগ নেই।

গত ১৭ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ প্রতিনিধি দলের প্রধান চার্লস হোয়াইটলি। বৈঠক শেষে পিটার হাস বলেন, আজ বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছি, যাতে আমরা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে পারি।

চার্লস হোয়াইটলি বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে আমরা বিবৃতি দিয়েছি। আজকের আলোচনা খুবই ফলপ্রসূ ছিল। কীভাবে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আধুনিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারি, সেটাই ছিল আলোচনার বিষয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ব্যাপারে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, আমরা উভয় দেশ আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা করেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের একটি বড় উন্নয়ন সহযোগী। বাণিজ্যক্ষেত্রেও তারা একটি বড় অংশীদার। আমি গত ৫২ বছরের পথচলায় মার্কিন সহায়তার জন্য রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। আমরা উভয়েই আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার ব্যাপারে একমত। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার জন্য, বাণিজ্য আরও বিস্তৃত করা ও সরাসরি বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

তবে সাবেক রাষ্ট্রদূতরা বলছেন, যে কোনো দেশে অবস্থানরত ভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের যে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আয়োজনে যোগ দেওয়া সৌজন্যতা। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও স্বাভাবিক বিষয়। এর সঙ্গে সেই দেশের অবস্থান বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র অন্য পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে একমত যে, এ নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করায় আমরা হতাশ। নির্বাচনকালীন এবং এর আগের মাসগুলোতে যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র।

সার্বিক বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে অভিনন্দন জানিয়েছে। তাদের রাষ্ট্র থেকে সে রকম কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান সরকারকে অভিনন্দন জানায়নি। যেটা রাশিয়া, চায়না, ভারতসহ অন্য দেশ জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ইতালি থেকে সম্ভবত ঊর্ধ্বতন কেউ অভিনন্দন জানিয়েছে। কিন্তু অন্য কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই।

‘আমেরিকা ও কানাডা থেকে সে পর্যায়ের কেউ অভিনন্দন জানায়নি। সেজন্য এখানে একটি ‘বিষয়’ থেকে যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে তারা নির্বাচনের মূল্যায়নটা করবে। তাদের পর্যবেক্ষক এখনো বাংলাদেশে আছে। তারা নির্বাচনের মাসখানেক আগে এসেছিল। তারা নির্বাচনের বেশ কিছুদিন পরও আছেন। সেই মূল্যায়নটা তাদের দেওয়ার কথা।’

তিনি বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত অভিনন্দন জানাননি। কিন্তু তিনি বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন যেটা খুবই স্বাভাবিক। আমেরিকা আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক কার্যক্রম, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিনিয়োগ-সহযোগিতা সব সময় করে যাচ্ছে। এজন্য শঙ্কা যেটি রয়েছে, সে বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। এটা আরও কিছুদিন গেলে বোঝা যাবে। বিরোধীদল তো এখনো ঠিক হয়নি।

সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচন মূল্যায়নের বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার পর যদি দেখা যায় কোনো কিছু হয়নি, তখন ধরে নিতে হবে এটার ঝুঁকি কিছুটা কম। আমাদের গার্মেন্টস বা এক্সপোর্টে যদি তারা কোনো কিছু করে, সেটাই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে। নিষেধাজ্ঞা কিছু ব্যক্তির ওপর হয়তো দিতে পারে। সেটার চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর যদি কোনো অ্যাকশন নেয় সেটা খুব মারাত্মক হবে।

‘আমেরিকায় ম্যাক্সিমাম এক্সপোর্ট গার্মেন্টস। সুতরাং এখানে বিপুল প্রভাব পড়বে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এখন অনেক। ফরেন রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। এমন অবস্থায় আমেরিকা কিছু করলে সেটি মারাত্মক হবে। আমরা পজিটিভভাবে চিন্তা করতে চাই, আশা করি এমন কিছু হবে না। এখন রিপোর্ট পাওয়ার পর বোঝা যাবে, কী হচ্ছে বা হবে।’

এদিকে ভোটের পর সরকার গঠন এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নতুন মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক ইতিবাচক বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে, ভোট নিয়ে শঙ্কা কেটে গেছে। সামনে কঠিন কোনো কিছুর শঙ্কা নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘দুই দেশের (যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ) সম্পর্কই ডায়নামিক। সেটিই যদি ধরে নেই, তাহলে বলা যায় নির্বাচনের ব্যাপারে তারা তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। কিন্তু নির্বাচন জার্নির একটা স্টেপ। তারা অখুশিসেটা তারা বলেছে। সেক্ষেত্রে তারা তাদের মতামত দিয়েছে। তবে তারা কোনো অ্যাকশন নেবে কি না, সেটি বলেনি। তারা যে বিবৃতি দিয়েছে সেখানে শুধু ভবিষ্যৎ নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের যে মতামত আছে সেটি তুলে ধরেছে। বলেছে সামনের দিকে তারা কী ফোকাস করতে চায়। এখানে তারা অন্য কিছু বলেনি। সুতরাং, এখানে অনুমান করার জায়গা আছে বলে মনে করি না।

তিনি বলেন, আমরা এখন কী করি তার ওপর হয়তো তারা নির্ভর করবে। আর যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে সেগুলো যদি সমাধানের উদ্যোগ নেই, তাহলে তারা নেতিবাচক হওয়ার কারণ আছে বলে মনে করি না। প্রচলিত ধারায় যদি সব চলতে থাকে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভাবনাটা গ্রহণযোগ্য মনে না করি, তাহলে হয়তো তারা ভিন্ন চিন্তা করবে। এ মুহূর্তে আমার কাছে মনে হয় না তারা তাদের যে মতামত দিয়েছে তার বাইরে কিছু চিন্তা করছে।’

‘এটা আমার কাছে খুব বেশি অস্বাভাবিক বা বিরাট কোনো পরিবর্তন মনে হয় না। কারণ দুই দেশের সম্পর্ক বহু স্তরভিত্তিক হয়। একটা বিষয়ে তাদের আপত্তি থাকলেই যে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। সে কথা তারা কিন্তু বলছে, আমরাও বিষয়টি সেভাবেই দেখছি। যে কাজটা সঠিকভাবে করলে যে প্রশ্নগুলো উঠেছে, সেগুলোর সমাধান পাওয়া যাবে। সেদিকে আমরা একটু মনোযোগ দিলে সমস্যা বাড়ার আশঙ্কা নেই।’

এসব আলোচনা যখন বিভিন্ন মহলে চলছে, তখন ১৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো এক বার্তায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। জাতিসংঘ বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে জাতিসংঘের কান্ট্রি টিমের মাধ্যমে আপনার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, আমার মনে হয় আমাদের আগামী ছয় মাস দেখতে হবে আমেরিকার পক্ষ থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে কি না। আদৌ আসে কি না বা কীভাবে আসবে, সেটি দেখার জন্য আমাদের ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে। আমি মনে করি না নির্বাচন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো কিছু করবে। তারা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বসেছিল, এরকম মনে হয় না। আগামী ছয় মাস আমাদের দেখতে হবে সম্পর্ক কোন দিকে যায়।

তিনি বলেন, এটা ঠিক নির্বাচনের পূর্ববর্তী যে হাঁকডাক শোনা যাচ্ছিল, সে তুলনায় ভয়েস অনেকটা নমনীয় বলেই মনে হচ্ছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারীদের প্রতিবেদনের প্রভাব থাকতে পারে হয়তো। তবে সেটার ক্ষেত্রে কোনটা কতটুকু গুরুত্ব পাবে তা আমরা এখনো জানি না। তাতে কোন দেশ কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটিও জানি না।

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *