ভয়াবহরূপে ব্যাংক খাতের মন্দঋণ

বিশেষ সংবাদ লীড

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: ব্যাংক খাতে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে মন্দঋণের অঙ্ক। ২০২২ সালে এ ঋণ ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে তা ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মন্দঋণ বাড়ল ১৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

একই প্রতিবেদনের অপর সূচকে দেখা যায়, গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সাতটি ব্যাংক কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের একই সময়ে আট ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ১৯ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা বা বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন তা প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ প্রায় সাড়ে ছয়গুণ বেড়েছে।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে জালিয়াতিতে নাম আসা ব্যাংকই খেলাপি ঋণের শীর্ষে। অবশ্য নানা উপায়ে কিছু ব্যাংক অনাদায়ি বা বেনামি ঋণ নিয়মিত দেখাচ্ছে। ফলে খারাপ অবস্থায় থাকা সব ব্যাংক এই তালিকায় নেই। ডিসেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের হার ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৯৮ দশমিক ২২ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এছাড়া আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৮৭, বেসিক ব্যাংকের ৬৪, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫২, পদ্মা ব্যাংকের ৪৬ এবং বিডিবিএলের ৪২ শতাংশ ঋণ খেলাপি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন: এ মুহূর্তে মোট মন্দঋণ ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তাও আবার প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপি হিসাবে নেই।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি দেখানো যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। এ দুই ঋণকে বিবেচনায় নিলে প্রকৃত খেলাপির অঙ্ক সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তিনি মনে করেন, যতদিন ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আলাদাভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে না, ততদিন খেলাপি ঋণও কমবে না।

এদিকে জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে। এর ফলে খেলাপিদেরও ঋণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। নতুন আইনে সেই সুযোগ রাখা হয়েছে।

আইএমএফ-এর শর্ত মেনে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে এখনকার মতো শিথিল পদ্ধতিতে হিসাব করে এ তথ্য প্রকাশ করা হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, খেলাপি ঋণ হিসাব করার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে শিথিলতা রয়েছে, শিগগিরই তা তুলে নিয়ে আগের মতোই আন্তর্জাতিক পদ্ধতির আলোকে হিসাব শুরু হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অতি সাম্প্রতিক সময়ে কিছু উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। মনে হচ্ছে সেগুলোও কাজে আসবে না। যেখানে রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি হয়, সেখানে কিছুই করা যায় না। এমন প্রেক্ষাপটে ঋণ না দেওয়ার সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে, এটা খুব খারাপ-যা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুলনীতির কারণেই হয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ইদানীং ব্যাংক পরিচালকদের জন্য যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, তা পেশাদারির সঙ্গে কার্যকর করতে পারলে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে আসবে। তা না হলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হবে না।

জানা যায়, ব্যাংক খাতে সুশাসনের ঘাটতি আছে-দীর্ঘদিন অর্থনীতিবিদরা এমন কথা বলে এলেও খুব একটা আমলে নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। আস্থাহীনতাসহ বিভিন্ন কারণে সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংকে চরম তারল্য সংকটের বিষয়টি সামনে এসেছে। ডলার সংকটের মধ্যে টাকারও সংকট থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়ে ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে অনেক খারাপ অবস্থায় পড়া কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করা, ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল ও আদায় জোরদারসহ বিভিন্ন উপায়ে খেলাপি কমানোর একটি পথনকশা প্রকাশ করা হয়। চারটি সূচকের ভিত্তিতে ২০২৫ সাল থেকে ব্যাংকগুলোর ঋণ, আমানত বন্ধসহ বিভিন্ন কঠোরতা আরোপ করা হবে। একই সঙ্গে বেনামি ও ভুয়া ঋণ ঠেকানোসহ সুশাসন ফেরাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া তিন বছরের পরিবর্তে আগামীতে দুই বছর মন্দমানের খেলাপি থাকলে অবলোপনের সুযোগ দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতে ৪৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ বন্ধে দৃশ্যমান এবং কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই, যা কিছু করে কৃত্রিম এবং লোকদেখানো। সমস্যার গোড়ায় হাত দেওয়া হয় না। এ কারণে অবস্থার উন্নতি হয়নি বরং ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতের জন্য যে রোডম্যাপ দেওয়া হয়, তাতেও একটি ছাড়া বাকিগুলোয় অর্থবহ কিছু নেই।

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *