বড় হুমকি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট

জাতীয় লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: দেশের করোনা পরিস্থিতির ফের অবনতি ঘটতে পারে-এমন আশঙ্কা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, কোভিড-১৯-এর সবচেয়ে সংক্রমণশীল ধরন ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।

সীমান্ত এলাকার পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে কোভিড রোগী। এতে স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের টিকাদান কার্যক্রম। এছাড়া যে ঢিলেঢালা ‘লকডাউন’ চলছে, তা ডেল্টা মোকাবিলায় বেশ দুরূহ।

বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত, ঢাকায় যদি করোনার এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ শুরু হয়, তাহলে কোনোভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

তাই জরুরি ভিত্তিতে সীমান্তবর্তী এলাকা এবং যেসব জেলা-উপজেলায় ডেল্টার সংক্রমণশীলতা লক্ষণীয়, সেখানে কারফিউ জারি করতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে টিকা সংগ্রহ করে ওইসব এলাকায় মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনতে হবে।

নয়তো একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মতো প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যু দেখা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকদিন ধরে মৃত্যু ও সংক্রমণ ঊর্ধ্বগতি স্পষ্টত লক্ষণীয়। ঢাকার বাইরে সীমান্তবর্তীসহ অর্ধেকের বেশি জেলা শহরে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে।

ইতোমধ্যে সংক্রমণ ১৩ শতাংশ অতিক্রম করেছে। অথচ দুই মাস ধরে গণটিকা কার্যক্রমও বন্ধ। প্রায় ১৫ লাখ মানুষের জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ।

পরিস্থিতি সামাল দিতে চীনের কাছ থেকে টিকা কিনতে গিয়েও গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করায় নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

এমন সময় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআর পরীক্ষা করে জানিয়েছে, সংক্রমিত বিভিন্ন এলাকায় করোনাভাইরাসের চারটি ধরন পাওয়া গেছে। তবে এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ভারতীয় ধরন বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।

১৬ মে দেশে সর্বোচ্চ সংক্রমণশীল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করে আইইডিসিআর। বর্তমানে দেশে এই ভ্যরিয়েন্ট কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ চলছে বলেও প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চিত করেছে।

দেশের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে অধিক সংক্রমিত এলাকগুলোয় কারফিউ জারি করার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান।

তিনি বলেন, সরকার ঘোষিত ‘ঢিলেঢালা বিধিনিষেধ’ দিয়ে সর্বোচ্চ সংক্রমণশীল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এতে সংক্রমিত এলাকায় দ্রুত রোগী বাড়বে।

হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়বে, এতে চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে রোগীদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।

এ ধরনের পরিস্থিতি কারোরই কাম্য নয়। তাই সারা দেশে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়ার আগেই বর্তমানে কারফিউ জারি করে সংক্রমণশীল এলাকাগুলো সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।

সেখানে পরীক্ষার হার বাড়িয়ে দিতে হবে এবং দ্রুত টিকার ব্যবস্থা করে ওই এলাকার সবাইকে টিকার আওতায় আনতে হবে।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অবশ্যই শঙ্কার। করোনাভাইরাসের এই ধরনটি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যাপক ধ্বংস চালাচ্ছে।

তবে ভ্যারিয়েন্ট যেটিই হোক, সেটি নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং সামগ্রিকভাবে দেশে ব্যাপক টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে টিকার জন্য সরকার সর্বোচ্চ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

ব্রিটিশ গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর যে কোনো ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ভারতে পাওয়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণশীলতা অনেক বেশি। এক্ষেত্রে কার্যকর বিধিনিষেধ, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি গণটিকা কার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সরকারিভাবে চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা কেনা এবং কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় গণটিকা কার্যক্রম আবার কবে শুরু করা যাবে, সেবিষয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হার্ড ইমিউনিটির জন্য অন্তত ৭০-৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। করোনা থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো হার্ড ইমিউনিটির ওপর গুরুত্ব দিয়ে ফল পেয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের মতো অনেক দেশই গণটিকাদান কার্যক্রমের মাধ্যমে ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। সীমান্তবর্তী জেলায় শনাক্তের হার ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। এসব এলাকায় ব্যাপক হারে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু করা দরকার।

৮০ থেক ৮৫ শতাংশেরই কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তাই যাদের লক্ষণ প্রকাশ পায়, তাদের অবশ্যই চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। দেশের সামগ্রিক করোনা পরিস্থিতি বুঝতে হলে শনাক্ত রোগীর কমপক্ষে ১০ শতাংশের জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে।

সংক্রমিত এলাকায় পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালনে আধা সামরিক বাহিনীকে দায়িত্ব দিতে হবে। দ্রুত এসব ব্যবস্থা নেওয়া না হলে রোগী জ্যামিতিক হারে বাড়তে শুরু করবে।

তখন রোগীদের সেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড দিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু করে।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ৩ কোটি টিকা কেনার চুক্তি হয়। এমনকি টিকার মূল্য অগ্রিম পরিশোধও করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিমাসে ৫০ লাখ করে টিকা দেওয়ার কথা।

তবে দুই চালানে ৭০ লাখ ডোজ দেওয়ার পর চুক্তি অনুযায়ী টিকা দেওয়া থেকে বিরত থাকে সেরাম ইনস্টিটিউট। ফলে সরকারের টিকাদান কর্মসূচির স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।

নতুন করে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। প্রথম ডোজ নিয়েছেন-এমন প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজও দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সরকার চীন ও রাশিয়ার টিকা কেনার উদ্যোগ নেয়।

তবে যারা প্রথম ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছেন, তাদের দ্বিতীয় ডোজের ক্ষেত্রে এই টিকাই প্রয়োজন।

এদিকে কোভ্যাক্স থেকে ৬ কোটি ডোজের বেশি টিকা পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। এর মধ্যে ফাইজার-বায়োএনটেকের উৎপাদিত মাত্র ১ লাখ ৬২০ ডোজ টিকা ১ জুন দেশ এসেছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *