স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও স্বৃকীতি মিলেনি শহীদ ইউনুছ আলী মন্ডলের

রাজশাহী

নওগাঁ  প্রতিনিধি:  নওগাঁর ধামইরহাট থানার ফার্সিপাড়া গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনে শহীদ হন অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার ও ইউনুছ আলী মন্ডল। তাদের গ্রামের বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের হোগলবাড়িতে। এরমধ্যে অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার মুক্তিযোদ্ধার স্বৃকীতি পেয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও স্বৃকীতি মেলেনি শহীদ ইউনুছ আলী মন্ডলের। তাদের কবরটি অযন্তে অবহেলায় পড়ে রয়েছে। ফার্সিপাড়ার বাসিন্দা ও নিহতের স্বজনরা মুক্তিযোদ্ধার স্বৃকীতি দেওয়াসহ কবরটি বাঁধায়ের দাবী জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে পশ্চিম বঙ্গ (বালুরঘাট) থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার ও ইউনুছ আলী মন্ডল দেশের ভিতরে প্রবেশের পথে ধামইরহাট থানার ফার্সিপাড়া গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীরা তাদের আটক করে। তাদের তিনদিন ব্যাপী অমানবিক নির্যাতনের পর ১১ থেকে ২১ শে আগষ্টের মধ্যে শহীদ হন। ইউনুছ আলী মন্ডল এর বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের হোগলবাড়ি গ্রামে। তার বাবা মৃত রকিব উদ্দীন ও মা মৃত শরপী। সে সময় তারা ভুল করে ধামইরহাট কলেজের সামনে বেইলী ব্রীজের ওপর নিয়ে আসে। জায়গাটি ছিল ভয়াবহ মুক্তিফৌজ যে কোন সময় ওই ব্রীজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে। এই আশংকায় ব্রীজের নীচে-ওপরে সব সময় পাহারা থাকত পাক বাহিনী। সেদিনও ব্রীজে পাহারা ছিল পাক বাহিনী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিত ভাবে তাদের ঘিরে ফেলে। শহীদ আব্দুল জব্বার ও ইউনুছ আলীকে ধরে অদূরে অবস্থিত পাক বাহিসীর ক্যাম্প ফার্সিপাড়া গ্রামের চৌধূরীপাড়া গ্রামের চৌধূরী বাড়িতে নিয়ে যায়। এখানে পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন কাদবীর নেতৃত্বে চোখ বেঁধে হাতে বড় বড় লোহার পেরেক মেরে গাছে(আমগাছ) ঝুঁলিয়ে চাকু ও বেয়নেট দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন চালায়। তাদের কাছে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রচারপত্র কিছু লিফলেট। যা যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিত অবগত করতে জনসাধারনের মাঝে বিলি করার জন্য। পার্টির নির্দেশ নিয়ে আসেন। এসব পাওয়ার পর পাক বাহিনীর অত্যাচার আরো বেড়ে যায়।

তাছাড়া যে কোন ভাবেই হোক শহীদ আব্দুল জব্বার ও এর প্রকৃতি পরিচয় পাক হানাদাররা পেয়ে যায়। একজন নেতৃত্ব স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠককে হাতে পেয়ে তারা উল্লাসিত হয়ে এবং নির্যাতনের মাত্রাবৃদ্ধি করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য ও অবস্থান সম্পর্কে তার কাছ থেকে জানার চেষ্ট করে। কিন্তু শত নির্যাতনের মুখে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কোন তথ্যই তিনি প্রকাশ করেননি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পাক বাহিনীর কোন প্রশ্নের উত্তর দেননি এমনকি নিজের বিপন্ন জীবন উদ্ধারের জন্য কোন আবেদনও করেননি। একারণে তাদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি করে নতুন তুন নির্যাতনের কৌশল প্রয়োগ করে তারা ব্যর্থ হন। নির্মম নির্যাতনের এক পর্যায়ে তার চোখ ফেটে ও শরীর দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। জনশ্রæতি আছে- যে আব্দুল জব্বারকে এক পর্যায়ে পা উপরে রেখে গাছের সঙ্গে পেরেক মেরে নির্যাতন করা হয়েছে। সে সময় আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ তার অত্যাচারের খবর জানতো।

চৌধূরী বাড়ির মুল ভবন থেকে তিনদিন পর পাশে অবাঙ্গালী রাজাকার বাহিনীর বাড়ির উঠানের কড়ই ও আমগাছে ঝুঁলিয়ে পুনরায় নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। তারপরও তার নিষ্প্রাণ দেহের উপর নির্যাতন অব্যহত থাকে। পরে ইউনুছ আলী মন্ডলকে গুলি করে হত্যা করে দুজনের লাশ গর্ত করে মাটি চাপা দেয়। তাদের কে যেখানে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে ওই জমির মালিক মুক্তিযুদ্ধের সময় বেঁচে ছিলেন। তার সন্তান (মাজেদুল ইসলাম) ও স্বজনদের ওই জায়গাটি যতেœ রাখার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ১৮ অক্টোবরে জেলা ইউনিট কমান্ড, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ, সাংবাদিক, আইনজীবি ও বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিততে ওই কবরে স্মৃতি স্তম্ভ ও ফলক লাগানো হয়।

পরে শহীদ আব্দুল জব্বারকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বৃকীতি দেয়া হয়। জমির মালিক মাজেদুল ইসলাম বলেন, এক কবরে দুইজন শহীদকে সমাহিত করা হয়েছে। কবরটি আমার সম্পত্তির ওপর আছে। বেশ কয়েক বছর আগে কবরটি তারা ব্যক্তিগত ভাবে বাঁধাই করেছেন। তবে কবর টি অরক্ষিত ও জরাজির্ন ভাবে আছে। শহীদদের স্বজনদের বাড়ি অনেক দুরে হওয়ায় আমরা যতটুকু পারি হেফাজতে রাখার চেষ্টা করি। সরকারে কাছে দাবী কবরটি সংরক্ষণ করা হোক। শহীদ ইউনুছ আলী মন্ডলের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনেক চেষ্টার পরও বাবার নাম শহীদদের তালিকাভুক্ত করতে পারিনি। ২০১৭ ও ২০২০ সালে উপজেলায় যাচাই-বাছাইয়ের পর বাবার নাম ‘ক’ তালিকাভুক্ত করা হয়। এরপর গত ৪ মার্চে বগুড়া সার্কিট হাউজে সম্মেলন কক্ষে যাচাই-বাছাই কমিটির পরামর্শক্রমে পুনরায় বাবার কাগজপত্রাদি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাচাই বাছাই অন্তে গেজেটভুক্তি করার জন্য আবেদন করেছি। বাবাকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বৃকীতির দাবী জানাচ্ছি।

ধামইরহাট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার অফির উদ্দিন বলেন, ওই দুইজনকে শহীদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং ১৯৯৭ সালের ১৮অক্টোবরে তাদের কবরে স্মৃতি স্তম্ভ ও ফলক লাগানো হয়। দুইজনের মধ্যে একজনকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বৃকীতি দেওয়া হয়। কিন্তু ইউনুছ আলী মন্ডলের স্বৃকীতি মেলেনি। সরকার ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে দাবী ইউনুছ আলী মন্ডলকে শহীদের মর্যাদা ও স্বৃকীতি দেওয়া হোক। ধামইরহাট পৌরসভা প্যানেল মেয়র মুক্তাদিলুর হক বলেন, আমরা তাদেরকে শহীদ বললেও সরকারি ভাবে শহীদ মর্যাদা দেওয়া হয়নি। হত্যার আগে যত ধরনের নির্যাতন আছে তাদের ওপর চালানো হয়েছে আশপাশের এলাকাবাসী সবাই অবগত আছে। অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বারকে শহীদ স্বৃকীতি দেওয়া হলেও ইউনুছ আলী মন্ডললের মেলেনি। পাক হানাদার বাহিনীর হাতে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সবাইকে মুক্তিযোদ্ধার স্বৃকীতি দেওয়ার দাবী জানাই। ধামইরহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) গনপতি রায় বলেন, শুনেছি ফার্সিপাড়ায় একটি শহীদ কবর আছে। তবে তাদের বিষয়ে কিছুই জানিনা। মুক্তিযোদ্ধাদের শহীদের তালিকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *