স্পোর্টস ডেস্ক: শৈশবেই ক্রিকেটের সঙ্গে হাতেখড়ি। কৈশোরে এসে তা ডানা মেলে দিল আকাশে, খেলতে লাগলেন প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোতে। এক পর্যায়ে ডাক এলো রাজধানী থেকে, সেখানে প্রথম বিভাগেও সুযোগ পেলেন। কিন্তু পরের ধাপে যাওয়ার আগেই সাড়া দিতে হলো বাবার ডাকে।
‘ক্রিকেট নয়, বিদেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হও’-বাবার এমন চাওয়া ফেলতে পারেননি; তাই পাড়ি জমান ইউরোপে। কিন্তু ক্রিকেট যার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে, তাকে ক্রিকেট থেকে বিমুখ করে রাখে সাধ্য কার! ফখরুল হোসেনকেও রাখা যায়নি। পরদেশে জীবনযুদ্ধের মধ্যেও ঠিকই সময় করে সময় দিয়ে গেছেন ক্রিকেটকে। যার ফলও পেয়েছেন। সিলেটের ছেলে এখন পর্তুগিজদের জাতীয় দলে!
ফখরুল হোসেনের বাড়ি সিলেট শহরতলির আখালিয়ায়। বর্তমানে স্থায়ীভাবে পর্তুগালেই বসবাস করছেন। সম্প্রতি এসেছিলেন দেশে। ব্যস্ততার মধ্যেও তখন পর্তুগাল জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার গল্প শুনিয়েছেন ফখরুল। তার আগে শুনিয়েছেন দেশে ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততার গল্পও।
ছোটবেলাতেই ব্যাট-বল হাতে ক্রিকেট নিয়ে মেতেছিলেন ফখরুল হোসেন। খানিকটা বয়স যখন বাড়লো, তখন সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে যেতে শুরু করলেন। বাড়ি থেকে স্টেডিয়াম খুব বেশি দূরে না হওয়া আর যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় সেখানে গিয়ে খেলাটা কঠিন ছিল না তার জন্য। প্রতিভা দিয়ে নজরে পড়ে যান সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার। তাকে ডাকা হয় অনূর্ধ্ব-১৫ জেলা দলের জন্য। এরপর ধাপে ধাপে সামনে এগিয়ে যাওয়া।
ফখরুল বলেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৫ জেলা দল থেকে অনূর্ধ্ব-১৭ এবং অনূর্ধ্ব-১৯ জেলা দলে খেলেছি। পারফরম্যান্সের কারণে সিলেট জেলা দলেও সুযোগ পাই।’
ক্রিকেটে ফখরুলের ভূমিকা বামহাতি মিডিয়াম পেস বোলার। গ্রামীণফোন যখন পেসার হান্ট করেছিল, তখন অংশ নিতে ঢাকায় বিকেএসপিতে গিয়েছিলেন ফখরুল। সেখানে খুব বেশি সুবিধা করতে না পারলেও ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের নজরে পড়েন। ডাক আসে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগে খেলার। পরে সুযোগ পান প্রথম বিভাগেও।
ফখরুল বলেন, ‘প্রখ্যাত কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরীর অধীনে সাধারণ বীমা দলে খেলেছি। পরে উত্তরা ও লালমাটিয়ার হয়েও খেলি। এগুলো ২০০৪-০৫ সালের কথা।’
ঢাকার ক্রিকেটে যখন ফখরুল পায়ের তলায় শক্ত মাটি খুঁজে পাচ্ছিলেন, তখনই তার বাবা চাইলেন ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে। বাবার চাওয়াকে অসম্মান করতে চাননি ফখরুল। তাই রাজি হয়ে যান দেশের বাইরে যেতে। ইউরোপে প্রবেশও সহজ ছিল না তার জন্য। এই দেশ, সেই দেশ ঘুরতে ঘুরতে ২০১৪ সালের শুরুর দিকে পর্তুগালে ঢুকেন ফখরুল। এরপর সেখানেই স্থির হন। বিভিন্ন দেশে থাকা কিংবা পর্তুগালে যাওয়ার পরও ক্রিকেটকে ভুলেননি তিনি।
ফখরুল বলেন, ‘বিদেশে যেখানে ক্রিকেট খেলা দেখতাম, দৌড়ে চলে যেতাম। কারণ ক্রিকেট তো রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। সপ্তাহে ছুটি পেতাম শনি ও রবিবার। ছুটিতে ক্রিকেটে সময় দিতাম, ফিটনেস নিয়েও কাজ করতাম।’
ফখরুলের কাছ থেকেই জানা গেল, পর্তুগালে সিরাজুল খাদেম নিপু নামে তার এক বন্ধু আছেন, যিনি ক্রিকেট খেলেন। পর্তুগালে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ শুরু হয় মার্চ-এপ্রিলের দিকে। ফখরুল ক্রিকেটের পোকা, এটা জানা ছিল নিপুর। তিনিই ফখরুলকে সেখানে লিগে একটি দলে খেলার সুযোগ করে দেন। লিগে ধারাবাহিকভাবে ভালো করে যেতে থাকেন ফখরুল।
পর্তুগাল জাতীয় ক্রিকেট দলে ভারতীয়, পাকিস্তানি ও দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূতরা খেলছিল, এটা ফখরুলের মনে আশা জাগায়। নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে দেশটির জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। কিন্তু সময় গড়াতে থাকে, ডাক আর আসে না। কিছুটা হতাশাও পেয়ে বসে তাকে।
ফখরুল বলেন, ‘পর্তুগালে ভারতীয়, পাকিস্তানি, দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূতরাই ক্রিকেট বেশি খেলে। জাতীয় দলেও তাদের দাপট বেশি। আমি লিগ খেলে যেতে থাকলাম। ভালোও করলাম। কিন্তু বেশ কিছুদিন যাওয়ার পরও আমাকে জাতীয় দলে ডাকলো না। এতে আমি কিছুটা ভেঙে পড়তে শুরু করলাম।’
ফখরুলের হতাশার পারদ পুরোটা নিম্নগামী হওয়ার আগেই এলো সেই কাঙ্ক্ষিত ডাক। পর্তুগাল ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তা ও জাতীয় দলের নির্বাচক ড. স্যান্ডি প্রস্তুত থাকতে বললেন ফখরুলকে। জানিয়ে দিলেন, যে কোনো সময় জাতীয় দলে ডাক আসতে পারে। ফখরুল তখন অনুশীলন আর ফিটনেসের দিকে আরো মনোযোগী হলেন। গত বছরের অক্টোবরে ডাক এলো তার।
ফখরুল বলেন, ‘স্পেনে আইবেরিয়া কাপ টুর্নামেন্টের জন্য পর্তুগাল দলে আমাকে নেয়া হলো। টুর্নামেন্টে স্পেন আর জিব্রাল্টার দেশ দুটিও অংশ নেয়। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি মর্যাদার টুর্নামেন্ট এটি। স্পেনের মুর্শিয়ায় লামাঙ্গা ক্রিকেট ক্লাব মাঠে স্বাগতিকদের বিপক্ষে ২৫ অক্টোবর অভিষেক হয় আমার। উইকেট না পেলেও বোলিং ওপেন করে ৩ ওভারে এক মেডেনসহ ১৬ রান দেই।’
এরপর স্পেন আর জিব্রাল্টারের বিপক্ষে আরও তিনটি ম্যাচ খেলেন ফখরুল। এ দেশ দুটি আইসিসির সহযোগী সদস্য। স্পেনে টার্ফের মধ্যে ম্যাচ হয়। ফখরুলরা টার্ফে খেলে অভ্যস্ত ছিলেন না। তারপরও চার ম্যাচেই ইকোনমি বেশ ভালো ছিল তার, উইকেট পান তিনটি।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দেশ পর্তুগালে ফুটবলের জনপ্রিয়তাই তুঙ্গে। তবে ধীরে হলেও ক্রিকেট সাধারণ মানুষের দৃষ্টি কাড়ছে, এমনটাই জানালেন ফখরুল হোসেন। কয়েক বছর ধরে আইসিসির সহযোগিতায় পর্তুগালে বিকশিত হচ্ছে ক্রিকেট।
আইসিসির সহযোগী সদস্য হওয়ায় পর্তুগালের জন্য খুব বেশি ব্যস্ততা অবশ্য নেই। আগামী জুনে আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইউরোপ অঞ্চলের কোয়ালিফাইয়ার হবে বেলজিয়ামে। সেখানে পর্তুগালসহ ৮টি দল খেলবে।
এছাড়া আগস্টে ফিনল্যান্ডে আইসিসির একটি টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে পর্তুগালের। বেলজিয়াম আর ফিনল্যান্ডগামী দলে সুযোগ করে নেওয়াই ফখরুলের লক্ষ্য। সূত্র: বিডি-প্রতিদিন।
স্ব.বা/শা