ঋণখেলাপির আগেই অবলোপন!

অর্থনীতি

স্বদেশবাণী ডেস্ক: ঋণ এখনও খেলাপি হয়নি। তবুও অবলোপন করতে দৌড়ঝাঁপ করছে নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান-ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)। এটি সঠিক পথ নয় বলে মনে করেন আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, এটা করলে ভুল বার্তা যাবে। অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও করতে চাইবে। তাই কোনোভাবেই এ ধরনের সুযোগ দেয়া উচিত হবে না। কারণ এই সুযোগ গ্রহণ করে কোনো কারণ ছাড়াই নিয়মবহির্ভূতভাবে বিশেষ সুবিধা ভোগ করবে প্রতিষ্ঠানটি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এ কাজ করা ঠিক হবে না। টাকা আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় অন্যরাও এ সুবিধা নিতে চাইবে।

জানা গেছে, ঋণ মান খারাপ হওয়ার আগেই তা মূল খাতা থেকে বাদ দিতে চায় ইডকল। টাকার অঙ্কে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বেশির ভাগ ঋণ স্ট্যান্ডার্ড মানের হলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঋণ অবলোপন ও এর সুদ মওকুফের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানাটি।

তবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি বলে জানা গেছে। কিন্তু এর মধ্যেই ৩৯ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া বিপুল অঙ্কের ঋণ অবলোপন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইডকল পর্ষদ। ২৭৬তম বোর্ড সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্প্রতি ইকোনমিক রিলেশন বিভাগে অবলোপন এবং সুদ মওকুফের অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছে ইডকল।

অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এটা কোনো নিয়মের মধ্যে পড়ে না। মন্দমানের খেলাপি না হলে অবলোপন-সুদ মওকুফ কোনোটাই সম্ভব নয়। দিলে খুব খারাপ উদাহরণ হবে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৩ সালে সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) প্রোগ্রাম শুরু করে ইডকল। মাঝখানে প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ বিতরণ স্থিতি ছিল সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এসএইচএস প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইডকলের বিতরণকৃত ঋণের বর্তমান স্থিতি এক হাজার ৪২৪ কোটি। বর্তমান স্থিতির পুরোটাই খেলাপির পথে।

এর মধ্যে ৭০০ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন এবং সুদ মওকুফের আবেদন জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগেও এই প্রোগ্রামের আওতায় ১৯৫ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে ঋণ দেওয়া ৪৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৯টিরই অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।

উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়, এক বছরের কিস্তি পরিশোধের ধরন দেখে গ্রামীণ শক্তি, রুরাল সার্ভিস ফাউন্ডেশন (আরএসএফ) ও সৃজনি বাংলাদেশের ঋণ অবলোপন ও সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বোর্ড। এছাড়াও আরও দু’টি প্রতিষ্ঠান জিএইচইএল এবং বিআরআইডিজিই এর ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তবে দু’টি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরও খারাপ। এর মধ্যে হিলফুল ফুজুল সমাজ কল্যাণ সংস্থা ও ম্যাকস রিনিউএ্যাবল কোম্পানি লিমিটেড, চিঠিতে প্রতিষ্ঠান দুটিকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি উল্লেখ করে তাদের সুবিধা না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। যাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলমান।

ইডকল সূত্রে জানা যায়, ইচ্ছাকৃত এসব খেলাপির পেটে গেছে ১২০ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে হিলফুল ফুজুলের পেটেই গেছে ১১৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন অনুযায়ী, এসব ঋণ ব্যালেন্সশিট থেকে বাদ দিতে হলে খেলাপি অবস্থায় থাকতে হবে তিন বছর, যা আগে ছিল পাঁচ বছর। এরপর শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করার শর্ত রয়েছে।

কিন্তু ইডকলের দাবি, দু’টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও খেলাপি হয়নি। এতে বোঝা যায়, আইন অনুযায়ী যেখানে খেলাপি হয়নি সেখানে অবলোপনের কোনো সুযোগ নেই।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইডকলের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাহমুদ মালিক যুগান্তরকে বলেন, ঋণগুলো অবলোপনের আবেদন করেছি ঠিকই। কিন্তু এখনও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। ভালো মানের ঋণ অবলোপনের কোনো নিয়ম নেই। তবে জাতীয় বিবেচনায় এ উদাহরণ তৈরি হতেই পারে। তিনি বলেন, পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি বিভিন্ন কারণে সৌর বিদ্যুতের সংযোগ আর নিতে চাচ্ছেন না সাধারণ জনগণ। আগের কিস্তিও ঠিকমতো পরিশোধ করছেন না। বিশেষ করে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছি। তাই টাকাগুলো আগে থেকেই অবলোপনের আবেদন করেছি সরকারের কাছে।

সিইও আরও বলেন, সরকার থেকে ঋণ নিয়ে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে ইডকল। এসব ঋণের একটি অংশ আদায় হলেও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭০০ কোটি টাকা টাকা অবলোপন এবং সুদ মওকুফের আবেদন করা হয়েছে। আগামী সাত বছরের জন্য এই সুবিধাটি চেয়েছি।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিষয়ে তিনি বলেন, হিলফুল ফুজুল সমাজ কল্যাণ সংস্থা একটি ইচ্ছাকৃত খেলাপি প্রতিষ্ঠান। শুরুতে ভালো হলেও এক পর্যায়ে টাকা পরিশোধ বন্ধ করে দেয়। তাই পাঁচ বছর আগেই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করে রেখেছি। অনেক আগে থেকেই কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ম্যাকস রিনিউএ্যাবল কোম্পানি লিমিটেডও ইচ্ছাকৃত খেলাপি প্রতিষ্ঠান। তবে এর কাছে টাকার অংক কম।

এদিকে ব্যাংকবহির্ভূত এই সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণমান ভালোই ছিল। কিন্তু বছরের ব্যবধান খেলাপির হার বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ইডকলের খেলাপি ঋণের হার ছিল ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০১৫ সালে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে গিয়ে ঠেকে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের হার। এরপর ২০১৬ সালে খেলাপি ঋণ আরও লাফিয়ে ৮ দশমিক ৭০ এবং ২০১৭ সালে পৌঁছায় ১০ দশমিক ৯১ শতাংশে। ২০১৮ সালে আবার কিছুটা কমে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ ৭ দশমিক ১৫ শতাংশে নেমে আসে। বার্ষিক প্রতিবেদনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সাল শেষে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের হার ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ হয়।

অন্যদিকে গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রস্তুত করা রেড জোনের তালিকায়ও উঠে এসেছে ইডকলের নাম। যদিও পরে অজানা কারণে তা সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে ইডকলের সিইও মাহমুদ মালিক যুগান্তরকে জানান, রেড জোন নিয়ে মোটেও চিন্তিত নই। কারণ এটি একটি কাগুজে হিসাব।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *