নদীর ওপর ভাসমান এসি নৌকায় বসবাস করা কে এই যুবলীগ নেতা?

রাজশাহী লীড

বগুড়া প্রতিনিধি: বগুড়ায় এক যুবলীগ নেতার সন্ধান পাওয়া গেছে যিনি বাস করেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) নৌকায়। নৌকাটি আবার সিসি ক্যামেরায় ঘেরা। বগুড়াবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক তিনি। তাকে চরের রাজাও বলা হয়ে থাকে।

আলোচিত এই যুবলীগ নেতার নাম লুৎফর রহমান। তাকে পাগলা ডাকাত নামেই সবাই চেয়ে। তিনি জমিনে থাকেন না। থাকেন ডাঙ্গায়। চাঁদাবাজি, রাহাজানি, ছিনতাই, ডাকাতির কাজ শেষ হলেও জলে চলে যান। নদীর ওপর ভাসমান নৌকায় ঘুমান তিনি। তাও যেমন-তেমন নৌকা নয়; থাই গ্লাস লাগানো এয়ারকন্ডিশন্ড (এসি) নৌকা। বিলাসবহুল ওই নৌকায় টিভি-ফ্রিজ তো আছেই; সৌরবিদ্যুতেও চলে এসব। আছে সিসি ক্যামেরাও। তিনি যে নৌকায় বসবাস করেন সেটির দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট।

পাগলা ডাকাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। বসবাস পানিতে হলেও তার অপরাধ জল-স্থল সব জায়গা বিস্তৃত। কৃষকের জমির ফসল লুট, নৌকায় ডাকাতি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, জুয়ার আসর বসানো, যাত্রার নামে দেহব্যবসা, বিরোধপূর্ণ জমি নিজের নামে লিখে নেয়া, ডাকাতিতে বাধা দিলেই খুন, অপরাধী ও পলাতক আসামিদের আশ্রয় দেয়া ও প্রহসনমূলক সালিশ- কী করেন না তিনি?

এলাকায় তার একটা বাহিনীও রয়েছে। বাহিনীতে বিভিন্ন জেলার শতাধিক সদস্য রয়েছে। যারা তার হুকুম তামিলে ব্যস্ত।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর চরচালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের পূর্বপাড়ের বহুলাডাঙ্গা গ্রামের মুছা শেখ ওরফে দালাল মুছার ছেলে এই লুৎফর রহমান। তার ইউনিয়নের পাশের ইউনিয়ন জামালপুরের মাদারগঞ্জ ও ইসলামপুর এবং আরেক পাশে গাইবান্ধার সাঘাটার জুমারবাড়ী এলাকা। তিন জেলার সীমান্ত এলাকার মধ্যে পড়েছে বহুলাডাঙ্গা গ্রাম। তাই তার রাজত্ব ও কর্মকাণ্ড তিন জেলার ওই এলাকাগুলোতেই।

পাগলা ডাকাত ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। তিনি এখন চরের রাজা। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো এখন মানুষের মুখে মুখে। তার অপরাধগুলোও ওপেন সিক্রেট।

পাগলা ডাকাতের বয়স আনুমানিক ৪৫। চরবাসীর কাছে তিনি এক মূর্তিমান আতঙ্ক। একসময় নিজে চুরি-ডাকাতি করতেন। এখন সর্দার হয়ে গড়ে তুলেছেন পাগলা বাহিনী। বাহিনীতে আছে শতাধিক ডাকাত সদস্য। এসব অপরাধ করেই কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকার মালিক তিনি।

খুন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক, অস্ত্র, লুটপাটসহ একাধিক মামলা ঝুলছে তার মাথার ওপর। ওয়ারেন্টও আছে একাধিক মামলার। তবু দোর্দণ্ড প্রতাপেই এগিয়ে চলছেন বাহিনী নিয়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার আছে ২০০ গরু ও ৩০০ মহিষের বিশাল খামার। এগুলো চরে বিশাল এলাকাজুড়ে বিচরণ করে। অভিযোগ আছে, তার খামারের গরু-মহিষের বেশিরভাগই ডাকাতি করা।

তার সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাগলা ডাকাত কয়েক কোটি টাকার মালিক। বগুড়া জেলার সোনাতলা উপজেলার তেকানী-চুকাইনগর এলাকার তালতলায় তিন বছর আগে তার স্ত্রী বুলবুলি খাতুনের নামে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। এর বাজারমূল্য প্রায় অর্ধকোটি টাকা। নীলফামারী জেলা সদরের রামগঞ্জ এলাকায় চার বছর আগে একটি দ্বিতল বাড়ি কিনেছেন। ওই বাড়ির বাজারমূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। এ ছাড়া শতাধিক বিঘা জমি ও অর্ধশত পুকুরের মালিক তিনি।

শুধু তাই নয়; তিন সন্তানের জনক লুৎফর ছেলেদের নামেও ব্যাংকে প্রায় কোটি টাকা আমানত রেখেছেন বলেও অভিযোগ আছে। ‘পাগলা হাট’ নামে এলাকায় একটি হাটও করেছেন। তার ৬টি নৌকা ডাকাতির কাজেই বেশি ব্যবহার হয়। এর একটিতে তিনি বাস করেন।

লুৎফরের বিরুদ্ধে সারিয়াকান্দি থানায় ৬টি, সোনাতলা থানায় ৩টি, জামালপুরের ইসলামপুর থানায় ৩টি ও গাইবান্ধার সাঘাটা থানায় ২টি এবং জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানায় ২টি মামলার খবর পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে ৫টি মামলার।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পাগলা ডাকাত আগে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রায় আট বছর আগে যুবলীগে যোগ দেন। পাঁচ বছর আগে যুবলীগের ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি হন পেশিশক্তির বলে। এখনও এই পদে বহাল তিনি। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দল থেকে মনোনয়ন চেয়ে পাননি।

স্থানীয়দের অনেকেই ভয়ে তার অপরাধ নিয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করার সাহস পান না। তবে কিছু লোক তার অন্যায়ের প্রতিবাদও করছেন। তাদের মধ্যে একজন আবদুল হান্নান। তিনি গত ১৪ অক্টোবর বগুড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে লুৎফর রহমান ওরফে পাগলা ডাকাতের অপকর্ম তুলে ধরে তাকে গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানান। এর পরই তার ওপর নেমে আগে খড়গ। পাগলার হুমকিতে এখন আর এলাকায় যেতে পারছেন না হান্নান। তিনি বর্তমানে জয়পুরহাটে অবস্থান করছেন।

স্থানীয় চালুয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী গণমাধ্যমকে বলেন, পাগলা ডাকাতের অপরাধের কথা সবাই জানে কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। ওই এলাকার কয়েকজন ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাগলা ডাকাতের অত্যাচারে আমরা এলাকায় টিকতে পারছি না। প্রতিনিয়ত সে লুটপাট, ডাকাতি ও মাদকের ব্যবসা করে এলাকায় রামরাজত্ব কায়েম করেছে। তাকে দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানান তারা।

অভিযোগের বিষয়ে লুৎফর রহমান ওরফে পাগলা বলেন, সামনে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। আমি এবার নির্বাচনে দাঁড়াব, প্রতিপক্ষ আমাকে নির্বাচনে পরাজিত করতে ও দলীয় মনোনয়ন যাতে না পাই, সে জন্য নানা অপবাদ ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, তার খামারে নিজের টাকায় কেনা ১০০ গরু ও ২০০ মহিষ আছে। সোনাতলায় তার বাড়ির মূল্য ২০ লাখ ও নীলফামারীর বাড়ির মূল্য ৩০ লাখের বেশি হবে না। তার নৌকার বিষয়ে বলেন, নদী এলাকায় বসবাস করতে গেলে নৌকা ছাড়া চলে না। আমি শখ করে একটি নৌকা বানিয়েছি।

লুৎফর রহমান পাগলা ডাকাতের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগগুলো স্বীকার করে সারিয়াকান্দি থানার ওসি আল আমিন যুগান্তরকে বলেন, তার বিরুদ্ধে সারিয়াকান্দি থানায় তিন-চারটি মামলা রয়েছে। তবে মামলাগুলো বহু আগের। তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টও আছে। কিন্তু সে নৌকায় থাকে। তাকে ধরা যাচ্ছে না। পুলিশ একদিন থেকে অভিযান চালালে পালিয়ে অন্যদিকে চলে যায়।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *