দুর্বল তদারকির কারণেই আর্থিক খাতে দুর্নীতি

জাতীয় লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: সরকারের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণেই মূলত আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। দুর্নীতি এখন সর্বব্যাপী। আমলাতন্ত্রের সংস্কার ছাড়া এই দুর্নীতি বন্ধ হবে না। এমন মন্তব্য করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৯-এ। এটি সোমবার কমিশনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে পেশ করা হয়।

প্রতিবেদনে সরকারের বিভিন্ন খাতের দুর্নীতি বন্ধে কমপক্ষে ৪০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: স্থায়ী সিভিল সার্ভিস সংস্কার কমিশন গঠন, থানাগুলোর দায়িত্বে এএসপি নিয়োগ, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস যুগোপযোগী করা ও ন্যায়পাল নিয়োগ। সরকারি ২৮টি সংস্থায় গবেষণা করে এ সুপারিশ দেওয়া হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বে দুদকের কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, কমিশনার এএফএম আমিনুল ইসলাম ও সচিব ড. মুহা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার রাষ্ট্রপতির কাছে ওই প্রতিবেদন দাখিল করেন।

রাষ্ট্রপতির কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিলের পর সোমবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করেন দুদক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, দুদক যখন বছরজুড়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশগঠনে কাজ করছে তখন উন্নয়ন সংস্থাগুলো বিদেশি টাকায় দিবসকেন্দ্রিক মানববন্ধনে ব্যস্ত ছিল। আমলাতন্ত্রের সংস্কার না হলে দুর্নীতি কমবে না। এ সময় তিনি সিভিল সার্ভিস সংস্কার কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন।

স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের যাত্রা ২০০৪ সালে। তবে ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছরই রাষ্ট্রপতির কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেয় দুদক। ২০১৯ সালে বার্ষিক প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান বলছে, বিচারিক আদালতে ৬৩ ভাগ মামলায় সাজা হয়েছে, যা ২০১৮ সালের মতোই। তবে ২০১৯ সালে বেড়েছে মামলা দায়েরের সংখ্যা।

২০১৯ সালে কমিশন কার্যক্রমের বিস্তারিত পরিসংখ্যান তুলে ধরে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। তার নির্দেশনা অনুসারেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। বিগত বছরগুলোয় মিডিয়া, সুশীল সমাজ, সমালোচকদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা পেয়েছি।

তিনি বলেন, কমিশনে যোগ দিয়েই বলেছিলাম কমিশন সমালোচনাকে স্বাগত জানাবে। কারণ, সমালোচনার মাধ্যমে কর্মপ্রক্রিয়ার ভুল-ত্রুটি উদ্ঘাটিত হয়, যা সংশোধনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে পরিশুদ্ধ করা যায়। এখন বলতে পারি, কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই কমিশনে অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, গত বছর থেকে ২০১৯ সালে মামলা এবং চার্জশিটের পরিমাণ কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। মামলা এবং চার্জশিটের গুণগত মান নিশ্চিত করার কারণেই কমিশনের মামলায় সাজার হার ৬৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ভবিষ্যতে কমিশনের মামলায় সাজার হার হবে শতভাগ।

সংবাদ সম্মেলনে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুদক বিগত বছরগুলোয় মূলত প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধ কৌশল পরিচালনা করছে। প্রশাসনিক কৌশলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সহজ। দুদক কমিশনার এএফএম আমিনুল বলেন, আমরা দিবারাত্রি পরিশ্রম করেছি। মামলার অনুসন্ধান-তদন্তের নথি পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মামলা সাজার হার বাড়ছে।

জানা গেছে, দুদক সরকারি সেবায় অনিয়ম-দুর্নীতি-দীর্ঘসূত্রতা রোধে খাতভিত্তিক বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে সুনির্দিষ্টভাবে ২৩টি খাত বা বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট আইন এবং স্বাস্থ্যখাতে সংস্কার। সড়কে যানবাহন ব্যবস্থাপনা, দীর্ঘমেয়াদি নৈতিকতার বিকাশে বিএনসিসি স্কাউটিং ও গার্লগাইডের কার্যক্রম জোরদার ও সরকারি সেবায় মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা।

দুদকের বার্র্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের লিজিং কোম্পানি, নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউট, সমবায় সমিতি আইন অনুসারে পরিচালিত সমবায় ব্যাংক ও মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিতে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন করে। দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রায়ই অভিযোগ আসে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত অর্থের লেনদেন হয়। দুদকের অনুসন্ধানেও এর সত্যতা পাওয়া যায়।

এসব সেক্টরেও বহুমাত্রিক দুর্নীতির সংক্রমণ ঘটেছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের উৎস বাধ্যতামূলকভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যাতে জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত অর্থের লেনদেন না হতে পারে-এ সংক্রান্ত একটি নীতমালা বা পরিপত্র জারি করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই-এমন মন্তব্য করে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের বৈশ্বিক দায়িত্ব। এ ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা ব্যতীত সমাজ থেকে দুর্নীতিসহ সব ধরনের অনৈতিকতা নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন। এ প্রেক্ষাপটে দেশে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যমান পাশ মার্ক ৩৩ শতাংশের পরিবর্তে ৫০ শতাংশে উন্নীত করা যেতে পারে।

এ ছাড়া মানসম্মত শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষকেরও কোনো বিকল্প নেই। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে নিয়মিত ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে অঞ্চলভিত্তিক দক্ষ প্রশিক্ষক প্যানেল সৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বাস্তবসম্মত ক্যারিয়ার প্ল্যানিং প্রণয়ন করতে হবে, যাতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে উৎসাহিত হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা হবে কারিগরি ও বিজ্ঞানভিত্তিক এবং উচ্চশিক্ষা হবে গবেষণাভিত্তিক।

দুদক ২০১৬ সাল থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে দুদক আইনের বিধিবিধান অনুসরণ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অথবা এদের অধীন দপ্তর বা সংস্থাগুলোর কার্যপ্রক্রিয়া পদ্ধতিগত সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সুপারিশ দেয়। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলো তেমন কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। কমিশন এটাও মনে করে, সরকারি সেবাদানে বিদ্যমান দুর্নীতি, হয়রানি নিরসনে পদ্ধতিগত সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। দুদক বিশ্বাস করে, এসব সুপারিশ বিচার-বিশ্লেষণ করে বাস্তবায়ন করা হলে জনগণ উপকৃত হবে।

দুদক বলছে, সংবিধানের ৭৭(১) অনুচ্ছেদে ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার বিধান রয়েছে। সংবিধানের ৭৭(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে ন্যায়পালকে মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যে কোনো কাজ সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ দায়িত্ব দেওয়ার সাংবিধানিক ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও সাংবিধানিক এই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা হয়নি। দেশের সুশাসন তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে ন্যায়পাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ প্রেক্ষাপটে দেশে ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে বিদ্যমান পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস যুগোপযোগী করা দরকার। কারণ, বিদ্যমান আইনের অধীনই বেশকিছু ক্রয় দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলাও দায়ের করেছে।

এ প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে দক্ষ বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করে দ্রুত সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার ফাঁকফোকর চিহ্নিত করে তা নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। ক্রয় প্রক্রিয়ার শুরু থেকে বিজ্ঞাপন বা প্রচারসহ তা শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিদ্যমান পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, বিধি ও ইজিপি সিস্টেম কার্যকর করতে হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *