স্বদেশবাণী ডেস্ক: ডান হাতের চারটা আঙুলই নেই রাসেলের। পঙ্গু হাতের কব্জি নিয়েই সে ঘুরে বেড়ায় সকাল থেকে রাত অবধি। তবে ভিক্ষা নয়, সেই একটিমাত্র আঙুলকেই তার জীবিকার প্রধান হাতিয়ার বানিয়েছেন প্রায় ১০ বছর ধরে। নিজের মা, স্ত্রী আর ২ কন্যাসন্তানের ভরণ-পোষণও করছেন।
ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকার দয়াগঞ্জ বাজারের নান্নু মিয়ার বাড়ির ৮ ফুট বাই ৭ ফুটের ছোট্ট কামরায় তাকে নিয়ে পরিবারের পাঁচজনের বসবাস। কী করে সেই একটি আঙুলই হয়ে উঠল রাসেলের বেঁচে থাকার উপায়- তা নিয়েই কথা হয় যুগান্তরের সঙ্গে।
মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে রাসেলকে নামতে হয়েছিল জীবিকার টানে। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ছোট। ওই বয়সেই রাসেল কাজ নিয়েছিল সায়েদাবাদ এলাকার একটি ছাপাখানায় (প্রিন্টিং প্রেস)। বয়স যখন ১১ কি ১২ তখন একদিন ছাপা হওয়া আগরবাতির মোড়কের কাগজ কাটতে গিয়ে প্রেসের অটোমেটিক কাটিং মেশিনে ডান হাতের কব্জি ঢুকে যায়। মুহূর্তেই কব্জি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ৩টি (মধ্যমা, অনামিকা ও কনিষ্ঠা) আঙুল। বাকি ২টি আঙুলও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ওই প্রেস মালিকের সহায়তায় প্রায় ৩ মাসের চিকিৎসার পর বাকি থাকা ২টি আঙুলের মধ্যে বৃদ্ধাঙ্গুলি পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেলে তর্জনীর আঙুলটিই কোনোমতে থেকে যায় রাসেলের কব্জিতে। বেকার হয়ে যাওয়া রাসেলের চোখেমুখে যখন অন্ধকার তখনই সাহায্যের হাত বাড়ান ওই এলাকার স্বপন নামের একজন।
পেশায় গ্রিজ মিস্ত্রি স্বপনই তখন রাসেলকে গ্রিজ লাগানো শেখান। এরপর থেকে আজ অবধি গ্রিজ লাগানোই হয়ে উঠে পঙ্গু রাসেলের একমাত্র পেশা। বিভিন্ন মার্কেট, দোকানপাট কিংবা আবাসিক বাড়ির সাঁটার গেট, কলাপসিবল গেটে গ্রিজ লাগানোর কাজ করেন রাসেল।
তিনি জানান, তার কাজের সবচেয়ে বড় জায়গা নারায়ণগঞ্জ শহর। প্রচুর মার্কেট আর বিপণিবিতান থাকায় গত কয়েক বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ শহরই তার কাজের প্রধান ক্ষেত্র। এছাড়া বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জ বা ঢাকার চকবাজারেও কাজ করেন মাঝে মধ্যে।
রাসেল জানান, এলাকার সেই স্বপনই তাকে শিখিয়েছে কী করে লোহার দরজায় গ্রিজ লাগাতে হয়। আর এ কাজে সঙ্গী হয়ে উঠে তার বেঁচে যাওয়া একমাত্র আঙুলটি।
ঢাকার টিকাটুলী এলাকা থেকে ১৩০-১৪০ টাকায় ১ কেজি গ্রিজ কিনেন রাসেল। সঙ্গে প্রয়োজন হয় পোড়া মবিলের, যা তিনি সংগ্রহ করেন বিভিন্ন মোটরসাইকেল বা গাড়ির গ্যারেজ থেকে। কখনও পোড়া মবিল কিনে নিতে হয় আবার কখনও পাওয়া যায় ফ্রি।
একটি সাঁটারের দরজা বা কলাপসিবল দরজায় গ্রিজ লাগিয়ে দিতে রাসেল ৩০ বা ৪০ টাকা নিয়ে থাকেন। অনেকে পঙ্গু রাসেলকে কাজ করতে দেখে দয়াবৎসল হয়ে দিয়ে দেন দ্বিগুণ পারিশ্রমিক। এভাবে সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে রাসেলের কাজ। প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪শ’ টাকা আয় হয় তার। তবে করোনাকালে সব কিছু বন্ধ থাকায় প্রায় আট মাস রাসেলের কাজ বন্ধ ছিল।
রাসেল জানান, করোনার কারণে কাজ বন্ধ থাকায় অনেক অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। বাড়িওয়ালা ভাড়া মাফ করলেও পেট চালাতে হয়েছে মানুষের দেয়া ত্রাণের ওপরই।
রাসেল আরও জানান, ছোট্ট এক কামরার সংসারে আছেন তার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী আর রাবেয়া (৫) ও জান্নাতুল (২) নামের মেয়ে।