কৃত্রিম সংকটে নাজেহাল, খাবারের দামে আগুন

জাতীয় লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: ‘করোনার ভয়ে লোকজন বেড়াতে কম বের হবেন- এমন ধারণা ভুল প্রমাণ করে আমাদের আনন্দ-ভ্রমণকে চরম ভোগান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমাদের মতো অপরিকল্পিতভাবে ভ্রমণে বের হয়ে অনেক পর্যটক সৈকত, বালিয়াড়ি, পার্ক করা গাড়ি, ফুটপাত, দোকানের সামনে ও রাস্তার ধারে রাত কাটিয়েছেন।’ আগাম রুম বুকিং না দিয়ে বিজয় দিবস ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে তিন দিনের ভ্রমণে কক্সবাজারে বেড়াতে এসে এভাবেই ভোগান্তির বর্ণনা দেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের মর্তুজা মোরশেদ। পরিবার ও স্বজনদের মিলিয়ে ২২ জনের টিম নিয়ে তিনি বেড়াতে আসেন। এদিকে পর্যটন মৌসুমে তিন দিনের ছুটিতে বিপুলসংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটবে আঁচ করতে পেরে এক শ্রেণির দালাল চক্র হোটেল রুম বুকিং দিয়ে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে। তারা অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। একইভাবে খাবার হোটেলগুলোতেও অরাজকতা বিরাজ করে। প্রতিটি খাবারের দাম রাতারাতি চার থেকে পাঁচ গুণ বাড়ানো হয়। এক কথায়- সর্বত্র চরম অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

ঘুরতে আসা সুনামগঞ্জের প্রসেনজিৎ দাশ ও কিশোরগঞ্জ সদরের শফিকুল ইসলামও দুর্ভোগের কথা জানান। তারা বলেন, পরিচিত কয়েকজন বলেছিলেন, আগে হোটেল বুকিং দিতে। তখন মনে করেছিলাম করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের ভয়ে হয়তো লোকজন তেমন আসবে না। তাই হয়তো রুম পাওয়া যাবে। কিন্তু পরিবার নিয়ে এসে রুম না পেয়ে যে ভোগান্তি পেয়েছি তা আজীবন মনে থাকবে।

শুধু মোরশেদ, প্রসেনজিৎ ও শফিকুল নন, বিজয় দিবসের ছুটিতে অপরিকল্পিতভাবে বেড়াতে এসে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন হাজারো পর্যটক। এভাবে আসায় হোটেলে ঠাঁই না পেয়ে যাত্রীবাহী বাস, সৈকতের কিটকট চেয়ার (বিনোদন ছাতা), কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোনের ফুটপাত এবং দোকানের বাইরে অনেক পর্যটককে রাত্রিযাপন করতে হয়েছে। সৈকতের খোলা আকাশের নিচেও অনেকে রাত কাটিয়েছেন। বাস-ফুটপাতে রাত কাটালেও শৌচাগার না পেয়ে দুর্ভোগে পড়েন তারা। শৌচাগার নিয়ে নারীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন। গণশৌচাগার না পেয়ে অনেকে খোলা জায়গায়, রাস্তার ধারে মলমূত্র ত্যাগ করেন। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কেউ কেউ স্থানীয়দের বাসাবাড়িতে অবস্থান নিয়েও রাত্রিযাপন করেন। স্থানীয়দের বাসাবাড়িতে থাকতে গিয়ে অনেকে আবার নানা বিড়ম্বনার শিকার হন। ভোগান্তি ও হয়রানির মুখে অনেক পর্যটক ভ্রমণসূচি সংক্ষিপ্ত করে ফিরে গেছেন। বিকল্প স্থানে থাকতে গিয়ে অনেক পর্যটককে মোটা টাকা গুনতে হয়েছে। পরিবারসহ ভ্রমণ করতে আসা লোকজনদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজারে এক রাতে এক লাখ ২০ হাজার পর্যটকের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু টানা তিন দিনের ছুটিকে কেন্দ্র করে প্রথমদিনই দেড় থেকে দুই লাখ পর্যটক কক্সবাজার আসেন। তাদের এক-চতুর্থাংশ সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, ইনানী ও আশপাশের পর্যটন এলাকায় গিয়ে উঠলেও কক্সবাজার পর্যটন জোন কলাতলী ও শহরকেন্দ্রিক ছিলেন দেড় লাখের মতো পর্যটক। ফলে রুম না পেয়ে অনেকে ভোগান্তিতে পড়েন।

সূত্র জানায়, পর্যটন মৌসুম চলছে। তিন দিনের ছুটিতে বিপুলসংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটবে এটা আঁচ করতে পেরে এক শ্রেণির দালাল চক্র আগে থেকেই নিজেদের নামে হোটেল রুম বুকিং করে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে। তারাই অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এক হাজার টাকার রুম ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা, ২ হাজার টাকার রুম ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা, ৩ হাজার টাকার রুম ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা বা তার চেয়েও বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। পর্যটকরাও বাধ্য হয়ে বাড়তি টাকা দিয়েছেন। একইভাবে খাবার হোটেলগুলোতেও অরাজকতা বিরাজ করে। প্রতিটি খাবারের দাম রাতারাতি ৪-৫ গুণ বাড়ানো হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মুরাদ ইসলাম বলেন, অভিযোগ পেয়ে সি-পার্ল-১ ও ২ নামে ফ্ল্যাট আবাসনে শুক্রবার অভিযান চালান ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় অতিরিক্ত নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি এ ফ্ল্যাট পরিচালকদের পাঁচ হাজার টাকা এবং অপর আবাসন প্রতিষ্ঠান হোটেল ওপেলাকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

হোটেল সি নাইটের ব্যবস্থাপক শফিক ফরাজী বলেন, আমাদের পর্যটকরা অপরিকল্পিতভাবে ভ্রমণে বের হন। সব হোটেল-গেস্ট হাউজের যোগাযোগ নম্বর ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজে দেওয়া আছে। সেখানে যোগাযোগ করে সরাসরি বুকিং দিলে এমন ঘটনা ঘটত কম। এছাড়া সবাই শুধু বন্ধের দিনগুলোতে আসার জন্য মুখিয়ে থাকেন। এর ফলে চাপের কারণে পর্যটকরা থাকা-খাওয়া সবখানেই বাড়তি টাকা গুনতে বাধ্য হন।

ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি জিল্লুর রহমান জানান, ধারণার চেয়ে পর্যটকের সংখ্যা বেশি এসেছে কক্সবাজারে। একসঙ্গে অসংখ্য পর্যটক সমাগম ঘটায় সীমিত জনবল দিয়ে পর্যাপ্ত সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরপরও সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ বলেন, একসঙ্গে বিপুল পর্যটক আসায় চাপ বেড়েছে। এরপরও যারা নিয়ম না মেনে পর্যটকদের ঠকাচ্ছে বলে প্রমাণ মিলছে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সব হোটেল-রেস্তোরাঁ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নজর রাখা কষ্টসাধ্য। তাই কেউ প্রতারণার শিকার হয়েছেন বুঝলেই সৈকত এলাকার জেলা প্রশাসনের তথ্য সেলে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানান তিনি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *