স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা নিয়ে সংসদে ক্ষোভ

জাতীয় লীড

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সরকার এবং বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। তারা বলেছেন, বর্তমান সরকারের একটানা ১৩-১৪ বছরের শাসনামলেও দেশের তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশার চিত্র খুব একটা বদলায়নি। কবে নাগাদ বদলাবে- তাও কেউ জানে না।

সংসদ সদস্যরা আরও বলেন, অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। নতুন নতুন দৃষ্টিনন্দন ভবন হচ্ছে। কিন্তু দক্ষ এবং প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় তৃণমূলের মানুষ এর সুফল ভোগ করতে পারছে না। রোববার একাদশ জাতীয় সংসদের ১৮তম অধিবেশনের প্রথম দিনে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যরা এসব কথা বলেন।

এর আগে বিকাল ৫টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়। দিনের কার্যসূচি অনুযায়ী এক ঘণ্টার প্রশ্নোত্তর পর্বের পুরোটাই ছিল দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার উপস্থিতিতেই সরকার এবং বিরোধী দলের প্রায় সব সংসদ সদস্যই এ সময় স্বাস্থ্য খাতে তৃণমূল পর্যায়ের নানান সীমাবদ্ধতা এবং অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরেন।

প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে এ প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান। তিনি তার নির্বাচনী এলাকার স্বাস্থ্য খাতের চিত্র তুলে ধরে বলেন, এ খাতে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় তৃণমূলের মানুষ সুফল পাচ্ছেন না। সরকার চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিচ্ছে। কিন্তু তারা এলাকায় থাকেন না। তারা যাতে এলাকায় থাকেন- তা নিশ্চিত করতে হবে।

একই দলের আরেক সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ সম্ভু বলেন, জনবল সংকট বড় সমস্যা স্বাস্থ্য খাতে। এই সংকট যে কোনো মূল্যে দূর করতে হবে।

আওয়ামী লীগের এসএম শাহজাদা বলেন, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আমার এলাকার জনগণ চিপার মধ্যে আটকে আছে। এ থেকে উত্তরণ দরকার।

একই দলের গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স বলেন, আওয়ামী লীগ টানা ১৩-১৪ বছর ক্ষমতায়। অনেক উন্নয়ন হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে। কিন্তু এর সুফল তৃণমূলের মানুষ পাচ্ছেন না।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, জেলায় জেলায় হাসপাতাল হচ্ছে। মেডিকেল কলেজ হচ্ছে। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হচ্ছে। হাসপাতালের জন্য দৃষ্টিনন্দন বহুতল ভবন হচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু দক্ষ জনবল নেই। চিকিৎসক নেই। নার্স নেই। টেকনোলজিস্ট নেই। আইসিইউ নেই। সিসিইউ নেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। যে কারণে এ খাতের সুফল মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, এক্সরে মেশিন বেশিরভাগ হাসপাতালে নষ্ট থাকে। যেখানে সচল থাকে- সেখানে নি¤œমানের ফিল্ম দিয়ে এক্সরে করা হয়। এই রিপোর্ট দেশে-বিদেশের কোথাও কেউ গ্রহণ করে না।

একই দলের সদস্য ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালের জন্য নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ভেতরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল নেই। ক্যান্সার, কিডনিসহ জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা নিরুপায় হয়ে বড় বড় শহরে কিংবা রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে ছুটে আসে। তাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এসব ভবন করে কী লাভ।

তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের মাঝে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে চাইলে দক্ষ এবং প্রয়োজনীয় জনবল জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। শূন্য পদ পূরণে উদ্যোগ নিতে হবে।

জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামিম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসক, নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় স্বাস্থ্য খাতের সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন না। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। একইসঙ্গে তারা যাতে গ্রামে থাকেন- তাও নিশ্চিত করতে হবে।

একই দলের মহাসচিব ও সংসদ সদস্য মো. মুজিবুল হক চুন্নু করোনা টিকা কেনা বাবদ মোট খরচ জানতে চান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে।

বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশার কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। এ থেকে উত্তরণে স্বাস্থ্য খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে সবার আগে।

তিনি আরও বলেন, সরকার অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এটি যেন দলীয় বিবেচনায় না হয়। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নেতাদের মালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সত্যি যদি তাই হয়- তবে তা হবে দুঃখজনক। হারুনুর রশীদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে কী পরিমাণ জনবল ঘাটতি রয়েছে- তার পূর্ণাঙ্গ একটি তালিকা তৈরি করে দ্রæত পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে।

একই দলের ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করতে পারেনি চলতি অর্থবছরে। এটি দুঃখজনক। কেন তারা অর্থ খরচ করতে পারলেন না- তার জবাব মন্ত্রীকে দিতে হবে।

বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব ও সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান বলেন, আমার এলাকায় ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ৫০ এ উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় স্থানীয় মানুষ সুফল পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, শুধুমাত্র শয্যা বাড়িয়ে লাভ হবে না, যদি না দক্ষ জনবল থাকে।

গণফোরামের মোকাব্বির খান তার নির্বাচনী এলাকার বন্যার চিত্র তুলে ধরে বলেন, বন্যার্ত মানুষের পাশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না- এটি দুঃখজনক।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের সবাইকে টিকার আওতায় আনার বিষয়ে জানতে চান প্রশ্নোত্তর পর্বে।

জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতে নানান প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অসংখ্য প্রকল্প ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। আরও অনেক কাজ শেষ হওয়ার পথে।

তিনি বলেন, এই সময়ে অনেক মেডিকেল কলেজ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হয়েছে। আট বিভাগে আটটি বিশেষায়িত হাসপাতাল হয়েছে। অবকাঠামোগত প্রভুত উন্নয়ন হয়েছে। তবে এটা ঠিক আমাদের দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। তারপরেও করোনা মহামারির মধ্যে আমরা ১০ হাজার চিকিৎসক এবং ৫ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছি। আরও ১০ হাজার চিকিৎসক ও ৫ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

মন্ত্রী আরও বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে আমরা এই মহামারি মোকাবিলাটাকেই প্রাধান্য দিয়েছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা সফলও হয়েছি। আশা করছি, বাকি সমস্যাও পর্যায়ক্রমে দূর হবে।

করোনা মহামারির কারণে এর আগের দুই বছরের বাজেট অধিবেশন সংক্ষিপ্ত ছিল। বাজেট উত্থাপনের পর সম্পূরক বাজেট নিয়ে আলোচনা ও পাশ এবং নতুন অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আলোচনা করবেন সংসদ সদস্যরা। অন্য অধিবেশনের মতো এবারো সংসদ সদস্যদের করোনাভাইরাস নেগেটিভ সনদ নিতে হবে। তবে এবার নির্দিষ্ট দিনের জন্য তালিকা করে সংসদ কক্ষে ঢোকানোর নিয়ম থাকছে না। করোনাভাইরাস নেগেটিভ সনদ থাকলেই সব আইন প্রণেতা অধিবেশনে বসতে পারবেন।

এবারের বাজেট অধিবেশন মহামারিকালের অন্য বাজেট অধিবেশনগুলোর চেয়ে দীর্ঘ হতে পারে। করোনাভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও আগের মতো কড়াকড়ি থাকছে না। তবে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এবারের অধিবেশনে সংসদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এবং গণমাধ্যমকর্মীদের অধিবেশন চলাকালে সংসদে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

স্ব.বা/বা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *