চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রকাশ্যে খুন ও বোমাবাজির ঘটনায় আতঙ্কিত মানুষ, এমপির বিরুদ্ধে আসামি বাণিজ্যের অভিযোগ

বিশেষ সংবাদ রাজশাহী

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংবাদদাতা: একের পর এক প্রকাশ্যে খুন ও লাগাতার বোমাবাজির ঘটনায় অস্থির হয়ে উঠেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আতঙ্কিত মানুষ নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আধিপত্যের লড়াইকে দায়ী করেছেন। গত দুই সপ্তাহে জেলায় সাতজন নিহত হয়েছেন। তিনজনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

সর্বশেষ সোমবার (২৩ এপ্রিল) বিকেলে সদর উপজেলার সুন্দরপুরে নিজের বোমায় একজন ও সন্ধ্যার পর পৌরসভার টোলঘর এলাকায় ছুরিকাঘাতে এক কিশোর নিহত হয়েছে।

পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, পদ্মার বালুঘাট দখলে নিতে সুন্দরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মতিউর রহমান, কুখ্যাত বোমাবাজ ইসমাইল বকরি ও আজিম মেম্বারের নেতৃত্বে সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জনতার হাট এলাকায় শতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। প্রতিপক্ষ রুহুল মেম্বারের দলবলও পাল্টা বোমাবাজি করেন।

বিকেল তিনটার দিকে বোমা বহনের সময় আকস্মিক বিস্ফোরণে জিয়ারুল ইসলাম (৪০) নামের এক ব্যক্তি মারা যায়। নিহত জিয়ারুল ইসলাম চন্দ্রনারায়ণপুর গ্রামের কসিমুদ্দিনের ছেলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার এএইচএম রকিব মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, জিয়ারুলের কাছে থাকা ককটেল বিস্ফোরণে সে মারা গেছেন। কারণ প্রতিপক্ষ ঘটনাস্থল থেকে দুই কিলোমিটার দুরে অবস্থান করছিলেন। পুলিশ সোমবার রাতে বাদী মামলা করেছেন।

এলাকাবাসী জানায়, গত ১ ফেব্রুয়ারি উপ-নির্বাচনে আব্দুল ওদুদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তাঁর অনুসারী মতি চেয়ারম্যান, ইসমাইল বকরি, আজিম মেম্বারসহ দলবল পদ্মার বালুঘাট দখলের চেষ্টা করে আসছিল। এর আগে গত ১ এপ্রিল এমপি ওদুদের এসব অনুসারী আরেক দফা এলাকায় শত শত বোমা ফাটিয়ে বালুঘাট দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ রুহুল মেম্বারের দলবলের প্রতিরোধে তারা বালুঘাটের দখল নিতে পারেনি। অভিযোগ রয়েছে পদ্মার বালুঘাটের দখল নিয়ে দুই পক্ষে কিছুদিন ধরে লাগাতার বোমাবাজি ও পাল্টা বোমাবাজির ঘটনা ঘটালেও পুলিশ কার্যত: কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সর্বশেষ সোমবার নিহত হয় জিয়ারুল।

এদিকে, সোমবার সন্ধ্যার পর পৌরসভার টোলঘর এলাকায় কিশোর গ্যাঙের দুই গ্রুপের মধ্যে চলা হামলা পাল্টা হামলার মধ্যে ফাহাদ (১৬) নামের এক কিশোর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। নিহত ফাহাদ মসজিদপাড়ার মনিরুল ইসলামের ছেলে।

এলাকাবাসী আরও জানায়, এই ঘটনার একদিন আগে বেপরোয়া কিশোর গ্যাঙের দুই গ্রুপের মধ্যে শেখ হাসিনা সেতু এলাকায় ব্যাপক ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনার জের ধরে নিহত হলো কিশোর ফাহাদ।

এর আগে গত ১৩ এপ্রিল জেলার নবাব মোড়ে রানীহাটি ইউপি মেম্বার আলম আলীকে (৫০) প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে একদল সন্ত্রাসী। গত ৯ এপ্রিল সদর উপজেলার কালিনগর বাবলাবোনা গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলামকে কুপিয়ে খুন করে সন্ত্রাসীরা। গত ২৩ এপ্রিল শিবগঞ্জের সাহাবাজপুরে শ্রমিক সাদিকুর রহমানের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়েছে। গত ১৯ এপ্রিল সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের সাঁওতালপাড়ার ধান ক্ষেত থেকে ২৬ বছর বয়েসি এক যুবকের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।

এদিকে, গত ১৯ এপ্রিল ইফতারির আগে শহরের উদয়ন মোড়ে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় জেলা যুবলীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক খাইরুল আলম জেমকে (৫৪)। জেমের বাড়ি শিবগঞ্জ পৌরসভার মর্দানা গ্রামে। নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে খুন পাল্টা খুন, বোমাবাজি, প্রতিপক্ষের ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর অপরাধে জেমের বিরুদ্ধে ১৬ টি মামলা রয়েছে। নিহত খাইরুল আলম জেম জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন বলে সদর থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন নিশ্চিত করেন।

অন্যদিকে, জেম হত্যার অভিযোগে পুলিশ সোমবার রাতে ৫ জন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারকৃতরা হলো মেসবাহুল হক টুটুল, মাসুদ রানা, দাউদ ইব্রাহিম, শামীম রেজা ও মিলন হোসেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন জানান, নিহত জেমের ভাই মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে যে ৪৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন, গ্রেফতারকৃতরা সেই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। গ্রেফতারকৃতদের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

উল্লেখ্য, জেম হত্যা মামলায় পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেস ও গত উপ-নির্বাচনে এমপি ওদুদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বদ্বীতাকারী যুবলীগের সাবেক জেলা সভাপতি সামিউল হক লিটনকে মুল আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে জেম হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমপি আব্দুল ওদুদ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও জেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা তার বিরোধী পক্ষের লোকেদের আসামি করেছেন। করে চলেছেন আসামি বাণিজ্য। এমপি ওদুদ অবশ্য দাবি করেছেন জেম হত্যায় তার ভাই বাদী হয়ে এই মামলা করেছেন। তিনি কোন প্রভাব খাটাননি।

এদিকে, পুলিশ ও এলাকার সূত্রগুলি থেকে জানা গেছে, নিহত জেম শিবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। একই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আব্দুস সালামের সঙ্গে জেমের দুই যুগের রেষারেষি ছিল। বছর দুয়েক আগে সালাম মারা গেলে জেম নিজ এলাকা ছেড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে আশ্রয় নেন। খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদের শেল্টারে ছিলেন।

পুলিশের সূত্রগুলি আরও জানায়, জেম নিজ এলাকা ছেড়ে শহরে আসলেও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ত্যাগ করতে পারেননি। শহরে এমপি ওদুদের প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বিরোধে জড়ান। গত ১ ফেব্রæয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনে হওয়া উপ-নির্বাচনের আগে ও পরে শহরের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় জেমের সম্পৃক্ততা থাকলেও এমপির শেল্টারে থাকায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। যদিও এমপি আব্দুল ওদুদের দাবি জেম কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যুক্ত ছিল না। জেমকে হত্যা করে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা প্রতিশোধ নিয়েছে। কারণ জেম উপ-নির্বাচনে তার হয়ে কাজ করেছিলেন।

পুলিশ ও দলীয় সূত্রগুলি থেকে আরও জানা যায়, গত ৫ ডিসেম্বর স্থানীয় পৌর পার্ক মাঠে জেলা কৃষক লীগের সম্মেলনে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। জেম ও তার প্রতিপক্ষ মেসবাহুল হক টুটুল গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসবকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে পোষ্ট ও পাল্টা হুমকিমূলক পোষ্ট দিতেন জেম। খুন হওয়ার একদিন আগে জেম হুমকি দিয়ে ফেসবুকে একটি লাইভ করেন। এর পরের দিন প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন।

এদিকে, জেম হত্যার ঘটনাটি রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শহরের মধ্যে ঘটলেও এই মামলায় আসামি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এমপি আব্দুল ওদুদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে মামলায় জেলাজুড়ে হাট, ঘাট মালিক, বালু ব্যবসায়ী, চেয়ারম্যান মেম্বার থেকে শ্রমিক, শিক্ষক-ছাত্র বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ আসামি হয়েছেন যারা গত উপ-নির্বাচনে ওদুদ এমপির বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।

ওদুদ তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পৌর মেয়র মোখলেসুর রহমানের মালিকানাধীন গ্রামীণ ট্রাভেলসের জিএম ও জেলা শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি আসাদুজ্জামান ছানা ও গ্রামীণের কাউন্টার ম্যানেজার শামসুল হোদা সনি, রানীহাটি ইউপি চেয়ারম্যান রহমত আলী, চর বাগডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদ রানা টিপু, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কাদেরসহ এমন সব লোকেদের আসামি করা হয়েছে যারা জেমকে চিনতেনও না।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুল জলিল বলেন, যে কোন হত্যাকান্ড বেদনার। কিন্তু জেম হত্যায় এমপি ওদুদ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে জেলাজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষকে আসামি করেছেন। দলের ভেতরে ও বাইরে যারা গত উপ-নির্বাচনে তার বিপক্ষে ছিলেন তাদের অনেকেই জেম হত্যার আসামি হয়েছেন।

রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে জেম হত্যায় নিরাপরাধ ব্যক্তিদের জড়ানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে ও যুবলীগ নেতা জেম হত্যায় উদ্দেশ্যমুলকভাবে বিভিন্ন জনকে আসামি করা প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিব বলেন, বাদী যেভাবে এজাহার দেন সেটাকেই মামলা আকারে রেকর্ড করতে হয়। তবে তদন্তের পর আমরা বলতে পারব কারা অভিযুক্ত আর কারা নির্দোষ।

সূত্র: পদ্মাটাইমস

স্ব.বা/বা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *