বিএনপি নেতাদের মামলায় হঠাৎ গতি

জাতীয় বিশেষ সংবাদ লীড

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে হঠাৎ গতিসঞ্চার হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন আদালতে বর্তমানে বেশ কিছু মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। কোনো কোনোটি সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত থাকা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নাশকতার অভিযোগে করা মামলাগুলোও সচলের উদ্যোগ নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।

পুলিশের বিশেষ প্রতিবেদন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সূত্র ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সূত্রে এসব জানা গেছে। সূত্র বলেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় ৩৫ নেতার বিরুদ্ধেই ১ হাজার ৩৬২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিএনপির আইনজীবীদের অভিযোগ, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের নেতাদের অযোগ্য করতে এবং অন্য নেতা-কর্মীদের মাঠছাড়া করতে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।কারণ, রায়ে দুই বছর সাজা হলে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, মামলা তার নিজস্ব গতিতে চলছে।

সংবিধানের ৬৬ (২) এর (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর পার না হলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন।

গতিসঞ্চার হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ দুর্নীতির বিভিন্ন মামলা এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা দুর্নীতি ও নাশকতার অভিযোগে করা মামলা রয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনের আগে সরকারের উদ্দেশ্য বিএনপিকে মাঠছাড়া করা। প্রার্থী যদি না থাকে, তখন নির্বাচন কী হবে? এখন সেই লক্ষ্যেই তারা নেমেছে। তিনি বলেন, দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুরোনো মামলাগুলো আবার সচল করা হচ্ছে। মামলাগুলো দ্রুত শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছে তারা।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা প্রতিহিংসামূলক কোনো কাজ করছি না। আমাদের কাছে মামলার তালিকা রয়েছে, বিএনপির মামলাগুলো যদি সেই তালিকার মধ্যে থাকে, তাহলে সেগুলোও শেষ হবে। তবে সব অপরাধেরই বিচার হবে।’

ফৌজদারি মামলায় কারাদণ্ড হওয়ায় ইতিমধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তাঁর বড় ছেলে ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তারেকের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদকের করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় সর্বশেষ গত বুধবার তারেক রহমানের ৯ বছরের কারাদণ্ড ও তাঁর স্ত্রীর ৩ বছরের কারাদণ্ড হয়। এ নিয়ে ছয়টি মামলায় তারেক রহমানের যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হলো।

সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত। এ ছাড়া বিএনপির নেতা আমানউল্লাহ আমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং আমানের স্ত্রী সাবেরা আমান দুদকের দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলার রায়ে সাতক্ষীরার একটি আদালত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ায় তিনিও প্রার্থী হতে পারবেন না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এবং আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে সরকার বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছে।’

যেসব মামলা নিষ্পত্তিতে গতি
আদালত ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সূত্র বলেছে, ঢাকার বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলাটিতে গত ৮ জুন অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী মিয়া নুরুদ্দিন অপু ও বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য মোসাদ্দেক আলী ফালুর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার বিচারকাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে।বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও ভোলার সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে থাকা পৃথক দুর্নীতির মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এলডিপি নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমেদের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের একটি মামলা রায়ের পর্যায়ে রয়েছে।

পুলিশের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাশকতার বিভিন্ন মামলায় ঢাকার বিভিন্ন আদালতে প্রতিদিন সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। ঢাকার আদালতে গিয়েও তা দেখা গেছে। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুল হকের আদালতে গত ৯ মে থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্যা বুলু, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে করা মতিঝিল থানার একটি নাশকতার মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে আজিজুল বারী হেলাল, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ ৩৯ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলায় এবং আমানউল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খোকনসহ ৫১ জনের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।

ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত-৬-এ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সেলিমা রহমান, শিমুল বিশ্বাস, শরাফত আলী সপু, সাংবাদিক শওকত মাহমুদ, বরকত উল্যা বুলুসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ২০১৫ সালে করা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।

বিএনপির আইনবিষয়ক সহসম্পাদক এবং বিএনপির নেতাদের আইনজীবী জয়নাল আবেদীন মেজবাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, বেশ কিছু মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে রায় দেওয়ার এবং বিএনপির নেতাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাঁর কাছে নাশকতার অভিযোগে করা ৯৭টি মামলা আছে। এসব মামলায় সাক্ষীদের পুলিশ খুঁজে এনে আদালতে হাজির করছে।

জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘পাঁচ বছর আগের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে নাশকতার যেসব মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে, সেগুলো ৮-১০ বছর আগের মামলা। এসব মামলা নিয়ে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে, এমন মামলার কোনো তালিকাও আমাদের কাছে নেই।’

শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো সচল হচ্ছে
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে স্থগিত থাকা পুরোনো মামলাগুলো সচলের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এসব মামলায় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী। ইতিমধ্যে ২৫টি মামলা সচল করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের তদন্ত তদারক কর্মকর্তা বরাবর চিঠি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ ছাড়া সম্প্রতি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা জয়নাল আবদিন ফারুক, সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতি মামলার ওপর থেকে স্থগিতাদেশ উঠে গেছে।

বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ১৩৬২ মামলা
আদালত সূত্র বলেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় ৩৫ নেতার বিরুদ্ধে ১ হাজার ৩৬২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৮৫টি। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফের বিরুদ্ধে ১৬টি, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে ৪টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৫৪টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৫০টি, নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ৫টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৩টি, সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধে ৬টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে ৯টি এবং ভারতের শিলংয়ে অবস্থানরত সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা রয়েছে। বিএনপির নেতাদের আইনজীবীরা বলছেন, কোনো মামলায় এসব নেতার সাজা হলে তাঁরা আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির পুরোনো মামলা সচল করা হচ্ছে। আবার নতুন নতুন মামলা দেওয়া হচ্ছে। নাশকতার মিথ্যা অভিযোগে করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে দুদকের বিশেষ পিপি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, বিএনপির নেতাদের আইনজীবীদের অভিযোগ সঠিক নয়। মামলা তার নিজস্ব গতিতে চলছে। যেসব আসামি আদালতে হাজির থাকছেন, তাঁরা আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা চালাচ্ছেন। যাঁরা পলাতক রয়েছেন তাঁরা শুনানিতে অংশ নিতে না পারায় তাঁদের মামলা দ্রুত শেষ হচ্ছে।

স্ব.বা/বা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *