রাজশাহীতে ভ্রূণ হত্যা মামলার বাদীর বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা

রাজশাহী

স্টাফ রিপোর্টার:নারী নির্যাতনের একটি মামলা করেছিলেন গৃহবধূ তাজনুভা তাজরীন। সেই মামলার কোন আসামি গ্রেপ্তার হননি। নির্যাতনের কারণে গর্ভপাত হলে ভ্রূণ হত্যার আরেকটি মামলা করেন তিনি। এ মামলারও কোন আসামি গ্রেপ্তার হননি। এখন তাজনুভা তাজরীনের বিরুদ্ধেই একটি মামলা হয়েছে।

তাজনুভা তাজরীন বলছেন, মামলাটি ‘গায়েবি’। মামলার বাদীকে তিনি চিনতেনই না।

রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানায় গত ১৭ জানুয়ারি মামলাটি দায়ের হয়েছে। মামলার বাদীর নাম আতিক আহমেদ। এজাহার অনুযায়ী, তার বাড়ি নগরীর চন্দ্রিমা থানার নামোভদ্রা এলাকায়। ৭৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দেয়ার অভিযোগে তিনি মামলাটি দায়ের করেছেন। এজাহারে দেয়া মোবাইল নম্বরে মামলার বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কোন কথা বলতে চাননি।

ভুক্তভোগী তাজনুভা তাজরীন নগরীর শিরোইল এলাকার মৃত ইব্রাহীম আলী দেওয়ানের একমাত্র কন্যা। নগরীতে তাজনুভার রেস্তোরাঁর ব্যবসা ছিল। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর একই এলাকার আজাহার আলী আপেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। দুজনেরই এটি দ্বিতীয় বিয়ে। আজাহার আলী কাতারে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে চাকরি করেন। দেশে ফিরে বিয়ে করেছিলেন।

তাজনুভা জানিয়েছেন, তার স্বামী আপেল ছিলেন মাদকাসক্ত। বিয়ের পরদিন থেকেই মারধর করতেন। বিয়ের আগে ও পরে যৌতুক হিসেবে চার লাখ টাকা নিয়েছেন আপেল। আরও ১৫ লাখ টাকার জন্য নির্যাতন করতেন। ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তখন তিনি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কয়েকদিন পর আপেল ডিভোর্স লেটার পাঠান। এরপর তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তাজনুভা স্বামীর ডিভোর্স লেটার গ্রহণ করেননি। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তিনি বাবার বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। ১৬ মার্চ শাশুড়ি মোতাহারা বেগম জেনি তাকে ফোন করে বলেন, যা হবার হয়েছে। এখন তারা একসঙ্গেই থাকতে চান।

তাজনুভা বলেন, ‘আমি আমার সংসারের কথা বিবেচনা করে শাশুড়ির কথায় সাঁই দিয়ে ওই বাড়িতে যাই। কিন্তু শাশুড়ি সেদিন আমাকে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে গর্ভপাতের ওষুধ খাইয়ে দেন। সন্ধ্যা থেকে আমার রক্তপাত শুরু হয়। পরদিন আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করেন।

চিকিৎসকরা আমাকে জানান, বাচ্চাটা টিকবে না। এরপর আমি আমার স্বামী-শাশুড়িসহ ছয়জনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করি।’

পরবর্তীতে তাজনুভার পেটের সন্তানের যখন বয়স সাড়ে চার মাস তখন তার গর্ভপাত ঘটে। এ ঘটনায় গত বছরের ৩১ আগস্ট তাজনুভা শাশুড়িসহ চারজনকে আসামি করে ভ্রূণ হত্যার অভিযোগে আদালতে আরও একটি মামলা করেন। দুটি মামলার একজন আসামিকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি।

ভ্রূণ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বোয়ালিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল মতিন এরই মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দেন যে, মামলাটির সত্যতা পাওয়া যায়নি। অথচ আদালতের নির্দেশে পুলিশ সাড়ে চার মাস বয়সী অপূর্ণ বাচ্চাটির লাশ তুলে ডিএনএ সংগ্রহ করেছে। ডিএনএ’র রিপোর্টও আদালতে পৌঁছেছে।

এতে বলা হয়েছে, বায়োলজিক্যালি বাচ্চাটার মা তাজনুভা। তাই তাজনুভা পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর আদালতে ‘নারাজি’ দিয়েছেন। আগামী মার্চে মামলার নির্ধারিত দিনে আদালত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। এরই মধ্যে তাজনুভার বিরুদ্ধে বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।

তাজনুভা বলেন, নারী নির্যাতন মামলার ছয় আসামির মধ্যে চারজন জামিন নিয়েছেন। তার স্বামী এখনও পলাতক। এছাড়া কোহিনুর বেগম চন্দ্রা নামে তার আরেক ননদ জামিন নেননি। তিনি ঢাকায় থাকেন। পুলিশ এদের গ্রেপ্তারের কোন চেষ্টা করেনি। ভ্রূণ হত্যা মামলারও কোন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। উল্টো মামলাটির সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়েছে। অথচ তদন্ত কর্মকর্তা কোনদিন তার সঙ্গে কথা বলেননি। চিকিৎসার কাগজপত্র দেখেননি। তিনি নিজে দুদিন ফোন করলেও তদন্ত কর্মকর্তা সময় দেননি।

তাজনুভার অভিযোগ, পুলিশ তার সঙ্গে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করছে। এ কারণে রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) কমিশনারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগও দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। উল্টো তার বিরুদ্ধেই একটি মামলা হয়েছে।

তাজনুভার দাবি, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন পুলিশকে ম্যানেজ করে মামলাটি করিয়েছেন। মামলার বাদী আতিককে তিনি আগে চিনতেন না। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, আতিক তার স্বামী আপেলের বন্ধু।

আতিককে দিয়ে মামলা দায়ের করানোর অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে তাজনুভার শাশুড়ি মোতাহারা বেগম জেনির মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

ভ্রূণ হত্যা মামলার তদন্ত না করেই আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে বুধবার এসআই আবদুল মতিনের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিবারন চন্দ্র বর্মন বলেন, মামলার মূল আসামি হলেন তাজনুভার স্বামী। মামলা দায়েরের আগেই তিনি বিদেশে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। তাই তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। আর অন্য আসামিদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে। আর তাজনুভার বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে সেটি অন্য এক ব্যক্তি করেছেন। সে মামলাটিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

 

স্ব:বা/না

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *