মায়ের লাশ আটকে রেখে ছেলেকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে পুলিশে দিলেন রামেকের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা

রাজশাহী লীড

স্টাফ রিপোর্টার: আবার চেনা চেহারায় ফিরল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। মঙ্গলবার ভোরে বিনা চিকিৎসায় মারা যান মুক্তিযোদ্ধা ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা ইসাহাক আলীর স্ত্রী পারুল বেগম (৬৫)।

বিনা চিকিৎসায় ও অবহেলায় মায়ের মৃত্যুর প্রতিবাদ করেন ছেলে শিক্ষা কর্মকর্তা রাকিবুল। এরপর একদল ইন্টার্ন চিকিৎসক জোটবদ্ধ হয়ে রাকিবুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মারধরের পর মা পারুল বেগমের লাশ আটকে রেখে ছেলেকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। এ সময় ইন্টার্ন ডাক্তাররা হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করেন।

শেষে ছেলে রাকিবুলকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। পাঁচ ঘন্টা পর মুচলেকা দিয়ে স্ত্রীর লাশ রামেক হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে আনেন মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, সুচিকিৎসা নিশ্চিতে সরকারের বারবার নির্দেশনার পরও ইন্টার্নদের বেপরোয়া আচরণ একটুও কমেনি। উল্টো নিরাপত্তার কথা বলে তারা রামেক হাসপাতালে বিক্ষোভ করেছে।

মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী অভিযোগে বলেন, তার স্ত্রী পারুল বেগম (৬৫) ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। মঙ্গলবার ভোরের দিকে মাথায় প্রচণ্ড ব্যথায় প্রায় অচেতন হয়ে পড়েন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে।

সকাল ৭টার দিকে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে পৌনে ৮টার দিকে প্রথমে পারুল বেগমকে পাঠানো হয় ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে তখন কোন ডাক্তার ছিল না। রোগী বেশ কিছুক্ষণ মেঝেতেই পড়ে ছিলেন।

আধাঘন্টা পর পারুল বেগমকে ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় পারুল বেগমের ছেলে রাকিবুল হক লিটন ওয়ার্ডে দায়িত্বরত ইন্টার্ন ডাক্তার শোভন সাহার কাছে গিয়ে তার মাকে দেখার জন্য অনুরোধ করেন।

শোভন সাহা বলে দেন তার ডিউটি শেষ। পরের ডাক্তার এসে দেখবেন। এরপর লিটন যান আরেক ইন্টার্ন ডাক্তার আব্দুর রহিমের কাছে।

সেও জানিয়ে দেয় যে এখন বের হবে। রোগী দেখতে পারবে না। এভাবেই কেটে যায় আধ ঘন্টা। শেষে কোন চিকিৎসা ছাড়াই পারুল বেগম মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন।

রোগীর স্বজনরা অভিযোগে বলেন, চিকিৎসা ছাড়াই মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় ছেলে রাকিবুল ওয়ার্ডের ভেতরেই উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করছিলেন আর ডাক্তারদের অভিশাপ দিচ্ছিলেন। এসময় ইন্টার্ন ডাক্তার শোভন সাহা ও আব্দুর রহিমসহ আরও কয়েজন এসে তাকে গালাগাল দিয়ে ওয়ার্ড থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করেন।

রাকিবুলের সঙ্গে দুই ইন্টার্ন ডাক্তারের ধ্বস্তাধস্তি হয়। এরপরই এই দুই ইন্টার্ন অন্যদের ফোন করে ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে ডেকে নেয়। পরে রাকিবুলকে আটক করে বেধড়ক মারধর চলে কিছুক্ষণ।

পরে রোগীর স্বজনদের ওয়ার্ড থেকে বের করে দেয়া হয়। মৃত পারুল বেগমের স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীসহ স্বজনরা লাশ চাইলে ইন্টার্নরা লাশ আটকে পাহারা বসায়।

শেষে দুপুর সোয়া ১টার সময় মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়ে হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর লাশ নিয়ে যান। তবে পুলিশ ডেকে পারুল বেগমের ছেলে রাকিবুলকে রাজপাড়া থানার ওসির কাছে হস্তান্তর করে ইন্টার্নরা।

ইসাহাক আলী কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমরা হাসপাতালের ডাক্তারদের যে ভয়ংকর চেহারা দেখলাম; তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলবার নয়। যেখানে মানুষ বাঁচার জন্য আসে সেখানে এরা কারা কোন সমাজের মানুষ জনসাধারণের সেবা দিচ্ছে– প্রশ্ন রাখেন তিনি।

তিনি বলেন, এ অরাজকতার প্রতিকার কী? আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি; এমন অরাজকতা আর ভয়াবহতা দেখার জন্য নয়।

এই মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, আমার ছেলেকে অন্যায়ভাবে ও ঘটনা সাজিয়ে ইন্টার্ন ডাক্তাররা পুলিশে দিয়েছে। সে তার মায়ের মরা মুখটাও দেখতে পারবে না– এ কেমন দেশ!

ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজপাড়া থানার ওসি শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ইন্টার্নি ডাক্তাররা ঘটনার পর থেকে হাসপাতালের সব ওয়ার্ডে চিকিৎসা বন্ধ করে বসে ছিল। খবর পেয়ে আরএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে যান। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনেন।

‘দুপুরের পর পারুল বেগমের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ছেলে রাকিবুলকে পুলিশ আটক করেছে। ইন্টার্নরা অভিযোগ দিলে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

পুরো ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক বলে মনে করেন থানার ওসি।

চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করে রামেক হাসপাতাল ইন্টারর্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতা মিজান বলেন, পারুল বেগমের ছেলে রাকিবুলের হামলায় ইন্টার্ন ডাক্তার শোভন ও রহিম আহত হয়েছে। তাদের জখমের ধরণ কেমন জানতে চাইলে ইন্টার্ন নেতা মিজান বলেন, কিছুটা আহত হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়েছে।

তবে এই বিষয়ে রামেক হাসপাতালের পরিচালক বা অন্য কোন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের ফোন ধরেননি। এমনকি ঘটনার পর কোন সাংবাদিককে হাসপাতালেও ঢুকতে দেয়া হয়নি।

জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আটরশিয়া গ্রামে। সূত্র: যুগান্তর।

পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা ইসাহাক আলী পরিবার নিয়ে নগরীর বোসপাড়া টিকাপাড়ায় বসবাস করেন। ছেলে রাকিবুল শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *