স্বদেশ বাণী ডেস্ক : ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই নতুন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। এতে দ্বীপরাষ্ট্রটির সংকট কি শেষ হয়েছে, নাকি আরও জটিলতার দিকে গেছে, দেশটির উত্তোরণের পথই-বা কি? লঙ্কাকে উদ্ধারে কারা এগিয়ে আসছে, কাদের এগিয়ে আসার কথা? সর্বোপরি শ্রীলঙ্কা এখন কী করবে, সামনে কী হতে চলেছে? বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো সংকটে পড়বে কি না—এসব বিষয় নিয়েে এক গণমাধ্যমের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদুল আলম। তিনি বলেছেন, শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনার কোনো সুযোগ নেই।
প্রতিবেদক: বিক্ষোভের মধ্যেও বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। বিক্ষোভকারীরা রনিলকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চান না। তবে রনিল দেশকে দৈন্যদশা থেকে রক্ষা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। খাদে পড়া শ্রীলঙ্কাকে তিনি কি এগিয়ে নিতে পারবেন?
ফরিদুল আলম: রনিল বিক্রমাসিংহে নিঃসন্দেহে একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তিনি এর আগে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটটা বুঝতে হবে। দেশটির জনগণ সরকারবিরোধী সকল রাজনৈতিক দল দ্বারা মোটিভেটেড। এখনো শ্রীলঙ্কার মানুষ বিক্ষুব্ধ। গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর রনিল দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতিকে মেরামতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পরও জনগণ এর কোনটাকেই মানতে চাইছেন না। সুতরাং, বিদ্যমান সরকারবিরোধী দলগুলোর অবস্থান যেহেতু এখনো নতুন প্রেসিডেন্টের বিপরীতে, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি সামলে অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এ যেন পুরনো বোতলে নতুন মদ ঢালার মতো একটি বিষয়।
প্রতিবেদক: রনিল বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধে আন্দোলন তো চলমান, সামনে কি হতে পারে?
ফরিদুল আলম: শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও কমান্ডো মোতায়েন করা হয়েছে। দেশকে স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনে আগে থেকেই রনিল কঠোর হওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিলেন। গোতাবায়ার মতো রনিলকেও যদি পদত্যাগে বাধ্য করা হয়, তাহলে এই সংকট সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এমন কাউকে বিকল্প হিসেবে পাওয়া যাবে না। আমার মনে হয়, দেশটির সেনাবাহিনী কখনো রাজনীতিতে সেভাবে হস্তক্ষেপ না করলেও এবার তারা নিজে থেকেই দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে কঠোর হতে চাইছে। এভাবে তারা যদি বিদ্যমান অপর রাজনৈতিক দলগুলোকেও একই বার্তা দিয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।
প্রতিবেদক: শ্রীলঙ্কার উত্থান যেভাবে হয়েছিল, তাতে বোঝা গিয়েছিল দেশটি সিঙ্গাপুর বা দুবাই হতে চলেছে। যা বর্তমান অবস্থার সঙ্গে কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, যেন দেশটি বৃক্ষ হতে চেয়ে হয়ে গেছে ঘাস। দেশটির এই অবস্থা কী প্রত্যাশিত ছিল?
ফরিদুল আলম: এক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। শ্রীলঙ্কা বরাবরই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে ভালো অবস্থায় ছিল। তামিল বিদ্রোহ দমনে দেশটিতে শতভাগ সফল হন মাহিন্দা রাজাপাকসে ও সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। আর রাজাপাকসেরা বরাবরই চীনপন্থি ছিল। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ভারতের আধিপত্য রোধ ও তামিল বিদ্রোহ দমনে চীনের সঙ্গে সক্রিয় হন রাজপাকসেরা। চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তারা শ্রীলঙ্কাকে সিঙ্গাপুর বানিয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখেন। বর্তমান দূরাবস্থা এমনি এমনি আসেনি। স্বপ্নে বিভোর শ্রীলঙ্কা মেগা প্রকল্পের জন্য চীনের কাছে বড় অংকের ঋণ করে। তবে কর্জ নেয়ার আগে তারা নিজেদের সক্ষমতা ভালোভাবে পরীক্ষা করেনি। এর মধ্যে আসে কোভিড-১৯ মহামারি। শ্রীলঙ্কাকে ঋণের ফাঁদে ফেলে হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দরকে ৯৯ বছরের জন্য বাগিয়ে নিয়েছে চীন। এক্ষেত্রে শ্রীলক্ষার আমলাতন্ত্রেরও দায় রয়েছে। অপরদিকে চীন এখন নির্বাক।
প্রতিবেদক: আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব—লঙ্কানদের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কারা বেশি দায়ী?
ফরিদুল আলম: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থার জন্য রাজনীতিবিদদেরই বেশি দায়ী করা হচ্ছে। কারণ তারা সামনে থেকে জনগণকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কিংবা জবাবদিহিতা করছেন। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে দুর্নীতি—যা গত প্রায় দেড় দশক ধরে আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে চলছে। আজকে রাজনীতিবিদরা যা-ই করছেন, এর পেছনে মুখ্য কারিগর কিন্তু আমলারা। বিশেষ করে যারা সরকারের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে শীর্ষে অবস্থান করেন। রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে সরকারের সঙ্গে আমলাদের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করার পদক্ষেপ নিয়েছে গোতাবায়া সরকার। অর্থনৈতিক এই দৈন্যদশার পরও কিন্তু আমলাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছিলেন—যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এই সংকটে আমলাদের যেই ভূমিকা পালন করার কথা ছিল; তা তারা করেনি। সুতরাং, ভবিষ্যতে রাজাপাকসে পরিবারের বাইরে থেকে অন্য যে দলই সরকারে আসুক না কেন; আমলাতন্ত্রের বর্তমান চেইন ভাঙতে হবে।
প্রতিবেদক: আমরা শ্রীলঙ্কাকে বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত বলছি। কিন্তু দেশটির ঋণের বোঝা এমন বেশি হয়নি যে, তাকে উদ্ধার করা অসম্ভব। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো চাইলেই তো এগিয়ে আসতে পারে? তারা আসছে না কেন?
ফরিদুল আলম: শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ এখন সাড়ে ৬০০ ডলার। লঙ্কানদের উদ্ধারে সবার আগে পশ্চিমাদের কথাই মাথায় আসে। তবে, শ্রীলঙ্কার এই ঋণজালের মূল উৎস চীন, সেক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো চীনের ফাঁদে ফেলা শ্রীলঙ্কাকে উদ্ধার করতে আসবে না।
প্রতিবেদক: ইউরোপ-আমেরিকার কথা বাদই দিলাম। প্রতিবেশী ভারত কোথায়?
ফরিদুল আলম: শ্রীলঙ্কাকে যে ভারত সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসছে না; তা নয়। শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করতে ভারত এককভাবে চেষ্টা করেছে ও করছে। তবে তারাও কতদিন সেটি অব্যাহত রাখবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যেহেতু চীনের দিক থেকে কোনো ধরনের মানবিক সহয়তা পাওয়ার আশা দেখা যাচ্ছে না। গোতাবায়ার কৌশল হিসেবে এখানে রনিলকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে, যাতে ভারতের কাছে সহায়তার দিকটি নিশ্চিত করা যায়। ভারত তাদের ক্রেডিট লাইনের বাইরেও শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি সরবরাহ করছে, যা নিঃসন্দেহে অনন্য। রনিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ভারতের অব্যাহত সহযোগিতা কামনা করেছে। রাজনৈতিকভাবে এর বিশেষ ইঙ্গিত রয়েছে। এ মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
প্রতিবেদক: এটা তো ঠিক যে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না-থাকলে কোনো দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায় না। রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে দেশটির অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে কী?
ফরিদুল আলম: এক্ষেত্রে আমি বলব, রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তোরণে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দলগুলোকেই আগে ঠিক হতে হবে। তারা ঐক্যমতে পৌঁছাতে না পারলে এই সংকট কাটবে না। রনিলকে কেউ না-মানলেও সাংবিধানিকভাবে আপাতত নতুন নির্বাচন হওয়ার সুযোগ সীমিত। পার্লামেন্টে বিরোধীদের যে দুই তৃতীয়াংশ সমর্থনের দরকার; তা তাদের নেই। আবার পার্লামেন্ট ভেঙে নতুন নির্বাচন সংখ্যাগরিষ্ঠ এসএলপিপি কোনোভাবেই চাইবে না। কাজেই এই মুহূর্তে রনিলই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রেসিডেন্ট। সেক্ষেত্রে বিরোধীদের ঐক্যমত হতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে—রনিলের জায়গায় নতুন কেউ প্রেসিডেন্ট হয়ে আসলে স্থিতিশীলতা আসবে না, আবার ভারতের পছন্দ-অপছন্দেরও একটি বিষয় রয়েছে। তবে রনিলের নেতৃত্ব যে দেশটির জনগণ মানবে, সেটা বলা সহজ হবে না।
প্রতিবেদক: কথায় কথায় অনেকেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করছেন। এদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন কমে আসছে, দেশে বৈদেশিক ঋণও রয়েছে। সেক্ষেত্রে সত্যিই বাংলাদেশের ভয়ের কারণ আছে কি?
ফরিদুল আলম: শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে তুলনা করার কোনো অবকাশ রয়েছে বলে আমি মনে করি না। এটা ঠিক যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এই মুহূর্তে খুব একটা ভালো না। তবে সেটা শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বই এক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে আছে। সব দেশেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে জনজীবন কঠিন হয়ে পড়ছে।
সূত্র: সময় সংবাদ
স্ব.বা/ম