বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন: খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াল

জাতীয় বিশেষ সংবাদ লীড

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: কোনোভাবেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। বরং হু হু করে বাড়ছে খেলাপির অঙ্ক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

এপ্রিল-জুন সময়ে অর্থাৎ এই ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ৬ মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। আর ১ বছরে (জুন-২২ থেকে জুন-২০২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া খেলাপি ঋণের এ তথ্য বিশ্বাস করি না। ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ পুনর্গঠন, ঋণ অবলোপন এবং অর্থঋণ আদালতে মামলায় ঝুলে থাকা-সব ঋণ হিসাবে নিলে প্রকৃত খেলাপি সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার কম হবে না।

অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক দেখাচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এটা সঠিক নয়। উচ্চ ঋণখেলাপি থেকে বাঁচার উপায় একটাই-সেটা হচ্ছে একটা ঋণখেলাপি ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। সে ট্রাইব্যুনালে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির বিচার করতে হবে। খেলাপিদের সব সম্পদ ক্রোক করতে হবে। জেলে পাঠাতে হবে। এ ট্রাইব্যুনালের বিচারে কোনো আপিলের সুযোগ থাকবে না। এ ছাড়া খেলাপি থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় নেই।

মহামারি করোনার প্রকোপের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। গ্রাহককে ঋণ শোধ না করেও ঋণখেলাপি থেকে মুক্ত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কম সুদে ঋণ নেওয়া ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল ২০২২ সালেও। চলতি বছরও ঋণের কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে রয়েছে বিশেষ ছাড়। এমন সব সুযোগের পরও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না গ্রাহক। যার কারণে নানা উদ্যোগ নিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না-বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে ঢালাওভাবে সুবিধার কারণে ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকও বিপদে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

৩ মাস আগেও মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। প্রথম ৩ (জানুয়ারি-মার্চ) মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। এছাড়া এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের ২০ জুন জানায়, যদি কোনো গ্রাহক চলতি বছরের জুনের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দেয় সে খেলাপি হবে না। ফলে যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ না করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তারা কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হওয়ার সুযোগ পান। তবে শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেয়া হয়। সাধারণত ব্যবসা শুরু বা শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে মেয়াদি ঋণ নেওয়া হয়।

খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না বলে জানিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, খাতা-কলমে দেখানো হচ্ছে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই অঙ্ক অনেক বেশি। কারণ এখানে পুনঃতফসিল ও পুনঃগঠন করা ঋণের হিসাব নেই, এগুলো যোগ করলে খেলাপি আরও বাড়বে। তিনি জানান, খেলাপি ঋণ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা মানে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। এতে করে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে।

করণীয় জানতে চাইলে সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এখন সুবিধা বন্ধ করে খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, যেন আইনে গিয়ে বছরের পর বছর ঝুলে না থাকে। এছাড়া খেলাপিদের সম্পদ নিয়ে নিতে হবে। কঠোর অবস্থায় যাওয়া ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প উপায় নেই বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ঋণখেলাপিদের তো কিছুই হচ্ছে না। তারা উলটো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। তাহলে তারা ঋণ ফেরত দেবে কেন? বিদেশে ঋণখেলাপিদের সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়। আর এখানে তার উলটো। এতে ব্যাংক খাত ক্রমশই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে খাতটি শেষ হয়ে যাবে।

জানা গেছে, ডলার সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণের দারস্থ হয় বাংলাদেশ। ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। বাকি ছয় কিস্তির মধ্যে নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত আছে। ধাপে ধাপে ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। সব শেষ প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের হার ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। আর সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হারও নির্ধারিত মাত্রার অনেক উপরে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

স্ব.বা/বা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *