স্বদেশ বাণী ডেস্ক: দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অহরহ যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। একশ্রেণির শিক্ষক ও ছাত্রের যৌন নিপীড়নের ঘটনায় শিক্ষাক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। নিপীড়করা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। আবার অভিযোগ করেও ভুক্তভোগীরা প্রতিকার পান না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে উচ্চ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন নিপীড়নের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
জানা গেছে, নিপীড়নের শিকার ছাত্রীদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক অভিযোগ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সুরাহা করে না। উলটো তাদের শিক্ষাজীবনে নানা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এসব ঘটনায় অনেক শিক্ষার্থী আত্মহননের পথও বেছে নেয়। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। জবির আইন বিভাগের ছাত্রী অবন্তিকার আত্মহত্যার আগে দেওয়া ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়-তিনি যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী সিদ্দিক আম্মানকে দায়ী করেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ছাত্রী কাজী ফারজানা মীম একই বিভাগের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন ও বুলিংয়ের অভিযোগ করেছেন। বিচার না পেয়ে তিনি এবার রাষ্ট্রপতি বরাবর আবেদন করেছেন। আবেদনে তিনি বুলিং ও যৌন নিপীড়নের দৃষ্টান্তমূলক বিচারসহ প্রশাসনের জবাবদিহিতার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। যৌন নিপীড়নকারী শিক্ষক আবু শাহেদ ইমন ও বিভাগের চেয়ারম্যান জুনায়েদ আহমেদ হালিম অনার্স পরীক্ষার একাধিক বিষয়ে তাকে অকৃতকার্য দেখিয়েছেন। অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ১২ ফেব্রুয়ারি যৌন হয়রানির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনায়েদকে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ-দীর্ঘদিন ধরে বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থীকে তিনি যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিলেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে একাধিক ছাত্রীকে তিনি হেনস্তা করেছেন বলে অভিযোগ সামনে আসে। ঢাবি সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে একই বিভাগের এক ছাত্রীর করা যৌন নিপীড়নের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) স্নাতকোত্তর পর্বের থিসিস করতে গিয়ে রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রী শিক্ষক আবদুল মতিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগে তিনি জানান, ল্যাবে একা কাজ করার সময় এবং কেমিক্যাল দেওয়ার বাহানায় নিজ কক্ষে ডেকে দরজা আটকে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন ওই শিক্ষক। ২০ ফেব্রুয়ারি যৌন নিপীড়নের অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনিকে বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ১৪ মার্চ যৌন হয়রানির অভিযোগে ময়মনসিংহের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহাকে বরখাস্ত এবং বিভাগীয় প্রধান রেজোয়ান আহমেদ শুভ্রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সাজন সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক ছাত্রীকে অনুপস্থিত দেখিয়ে তিনি পরীক্ষায় নম্বর কম দিয়েছেন এবং থিসিস পেপার আটক রেখে যৌন হয়রানি করেছেন।
গাজীপুরে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মুজিবুল হকের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটির এক নারী কর্মকর্তাকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে। তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ না করে উলটো ওই নারীকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। বাউবির রাজশাহীর আঞ্চলিক কেন্দ্রের পরিচালকের বিরুদ্ধে নারী কর্মকর্তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী শিক্ষক ও ছাত্রের দ্বারা শিক্ষার্থী, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা হেনস্তার শিকার হচ্ছে। অথচ অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বরং অনেক সময় এমন অভিযোগ প্রশাসন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। যৌন হয়রানির অধিকাংশ অভিযোগই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিষ্পত্তি করে না। এ ধরনের অভিযোগের নিষ্পত্তিতে নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় প্রশাসন এমন আচরণ করছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়ার কারণে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমাদের ঘাড়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চেপে বসেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলে শিক্ষাঙ্গনের প্রতি মানুষের অনাস্থা বেড়ে যায়। এমন ঘটনায় অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ শাস্তি যেন নমনীয় না হয়। সাময়িক বরখাস্ত, বরখাস্ত বা বহিষ্কারের মতো শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এটি ফৌজদারি অপরাধ। তাই অন্য অপরাধীদের মতো তাদেরও শাস্তি পেতে হবে। এছাড়া বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা করা যাবে না। কারণ দীর্ঘসূত্রতার জন্যই ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম যুগান্তরকে বলেন, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সবখানে যৌন হয়রানি ঘটছে। এটি মোটেও ছোটখাটো অপরাধ নয়। এটি ফৌজদারি অপরাধ। এছাড়া সমাজের সবখানে নারীর প্রতি সংবেদনশীল মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পূর্ণকালীন সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, যৌন হয়রানি একটি সামাজিক ব্যাধি। অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাইকে আরও সোচ্চার হতে হবে। এ ব্যাপারে ইউজিসি কঠোর মনিটরিং করছে।