নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি প্রণোদনা বাস্তবায়নে ব্যাংকের গড়িমসি কেন

অর্থনীতি

স্বদেশবাণী ডেস্ক: সরকারের কাজ সরকার যথাসময়ে করেছে। ‘কোভিড-১৯’-এ ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সরকার মোট ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে ঋণ, নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করেছে। অনেক টাকা।

মোট প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। যথারীতি তা ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট এবং অন্যত্র ঘোষিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ সম্পর্কে জাতিকে অবহিত করেছেন।

এটি জরুরি পদক্ষেপ, অতীব জরুরি। কারণ গেল ফেব্রুয়ারি-মার্চে সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে, বিশেষ করে রপ্তানি শিল্প। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সরকার যথাসময়ে প্রণোদনা কর্মসূচি দিলেও আজ পর্যন্ত ওই টাকার ৪০-৪২ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়নি।

এর অর্থ কী? কারা এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে? মোট কত টাকা তারা এ পর্যন্ত ‘ডিসবার্স’ করেছে? ফেব্রুয়ারি মাস চলে যাবে শিগগিরই। করোনা ভীতি কিছুটা কেটেছে। জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। শিল্প-কল-কারখানা খুলছে। এখনই তাদের টাকার দরকার। তবু কেন তাদের প্রাপ্য টাকা বা অর্থ-সাহায্য এখনো ‘বিতরণ’ করা গেল না?

সবাই জানি, সরকারের প্রণোদনা কর্মসূচিটি ব্যাংক ঋণনির্ভর। বাজেটের মধ্যকার টাকা এখানে কম। তার মানে সিংহভাগ কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেশের ব্যাংকগুলোর।

কতগুলো ব্যাংক? ৬০টি ব্যাংক কার্যরত দেশে। তাদের শাখার সংখ্যা কত? এ মুহূর্তে কমপক্ষে ১০ হাজার ব্যাংক-শাখা দেশে আছে। কিছু ঋণ এনজিওগুলোর মাধ্যমেও দেওয়ার কথা আছে।

প্রশ্ন, এত বড় অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও কেন ব্যাংকগুলো প্রণোদনা কর্মসূচি পুরোপুরি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসছে না দ্রুত? লোকবল নেই, প্রশিক্ষিত লোকবল নেই, সিদ্ধান্তহীনতা, ঋণের টাকা আদায় হবে না-এমন দুশ্চিন্তা অথবা নিতান্তই জড়তা? কোন কারণটি সত্য তা আমার জানা নেই। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়-দায়িত্ব কতটুকু? এখন যেহেতু ব্যাংকের সব ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ও জড়িত, এমতাবস্থায় তাদের দায়িত্ব কতটুকু? প্রশ্নগুলো তুলছি কারণ, এখন আমাদের জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম। জীবন বাঁচানোর জন্য সরকার দ্রুত টাকার ব্যবস্থা করেছে।

ভারত আমাদের ২০ লাখ টিকা শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসাবে দিয়েছে। ৫০ লাখ কেনা টিকাও আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। মাসে মাসে তা আরও আসবে। এতে জনজীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হবে। কিন্তু খাওয়ার ব্যবস্থা কী? জীবিকার ব্যবস্থা কী? মিল-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি পুরোদমে চালু না হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কোত্থেকে আসবে? রয়েছে নন-ফরমাল সেক্টর। বিশাল কর্মকাণ্ড আবার শুরু করতে হবে। বলতে গেলে নতুন জীবন।

ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই টাকা ভেঙে ভেঙে চলেছেন। তাদের ‘ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল’ / চলতি মূলধন দরকার। রপ্তানির জন্য ‘প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট’ দরকার, কৃষকদের দরকার শস্য ও ফসল ফলানোর জন্য ঋণ। এসব জরুরি বিষয়। অথচ খবরে দেখা যাচ্ছে, ঋণ পাওয়ার যোগ্যরা এসব পাচ্ছে না। যত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তার মাত্র ৫৮ শতাংশ ‘ডিসবার্স’ করা হয়েছে। যেমন শিল্প-সেবা প্রতিষ্ঠানের চলতি মূলধন হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এ খাতে বিতরণকৃত অর্থের পরিমাণ মাত্র ২৮ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা।

অন্যান্য খাতের বিতরণের তুলনায় এ ক্ষেত্রে অবস্থা কিছুটা ভালো। ছোট-মাঝারি-ক্ষুদ্রশিল্পের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া আছে ৩০ হাজার কোটি টাকা, অথচ বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ১০ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্সিংয়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে বিতরণের পরিমাণ মাত্র ১২১ কোটি টাকা। এভাবে দেখলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে বোঝা যায় বিতরণ পরিস্থিতি কতটুকু দুঃখজনক।

এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, কর্মহীন দরিদ্র মানুষদের খাদ্য সহায়তা, গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ, পেশাজীবী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ স্কিম, শস্য ও ফসল চাষের জন্য রিফাইন্যান্সিং স্কিম, কৃষিকাজ যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে ধান-চাল সংগ্রহ নামক প্রণোদনা কর্মসূচির টাকা বিতরণের হাল ভালো নয়। অথচ কর্মসূচির নাম থেকেই বোঝা যায় এসব কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

হতাশাজনক চিত্র ধান-চাল সংগ্রহের। এর জন্য বরাদ্দ ৮৬০ কোটি টাকার এক টাকাও খরচ করা যায়নি। কৃষিকাজ যান্ত্রিকীকরণের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা। খরচ হয়েছে মাত্র ১৬৮ কোটি টাকা। অথচ এসব বরাদ্দের টাকা বিতরণের কথা ছিল গত অক্টোবরের মধ্যে। কেন তা হলো না? টাকার অভাব? প্রশ্নই ওঠে না। ব্যাংকগুলো এখন টাকায় টাকায় ভাসছে। অতিরিক্ত তারল্য তাদের নতুন সংকটের দিকে ধাবিত করছে। ‘স্ট্যাটুটরি লিক্যুইডিটি’ (বিধিবদ্ধ তারল্য) যা রাখার কথা, তার কয়েকগুণ বেশি রাখা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে যে ‘ক্যাশ’ রাখতে হয় তার দ্বিগুণ-আড়াইগুণ টাকা সেখানে রাখা আছে। এর অর্থ হলো, অর্থ সংকট কোনো কারণ নয়। ব্যাংকগুলো স্বাধীন দেশে ৫০ বছর কাজ করার পর বলতে পারবে না যে তাদের প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব আছে।

থাকতে পারে কিছুটা ক্রেডিট ও বৈদেশিক মুদ্রা বিভাগে। এর জন্য তারাই দায়ী। তারা জব রোটেশন করে না। অবকাঠামোর অভাব? প্রশ্নই ওঠে না। ১০ হাজারের মতো শাখা। প্রায় সব শাখাই এখন স্বয়ংক্রিয়। এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংসহ নতুন নতুন সেবা দিচ্ছে ব্যাংক। দু-একটি সমস্যা তাদের আছে বলে শুনি। এখন অনেক ব্যাংকে ‘ক্রেডিট ডিসিশন সেন্ট্রালাইজড’। ব্রাঞ্চের ক্রেডিট দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। ব্রাঞ্চ এখন ‘রিলেশনশিপ অফিস’।

এ ছাড়া একটি নতুন সমস্যা রয়েছে। ব্যাংকাররা বলছেন, সুদ ভর্তুকির টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেবে টাকা/ঋণ আদায়ের পর। এটি সত্যি হলে খুবই বড় বাধা। ব্যাংকগুলো চাপের মুখে আছে এমনিতেই। ঋণখেলাপ সমস্যা তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। ২০২০ সাল গেছে ‘বিলম্বে ঋণ শোধের’ বছর হিসাবে। ওই বছর কাউকে ঋণের টাকা ফেরত দিতে হয়নি।

২০২১ থেকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে তাদের। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটা সম্ভব নয়। সব ঋণকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণে পরিণত করে তিন বছরের কিস্তি করে দিতে হবে। এসব বেশ ঝামেলার কথা। এমনিতেই বাজারে গুজব, প্রণোদনার টাকা শেষ পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে না। এসব গুজব মারাত্মক। যার ফলে সব ব্যবসায়ীই প্রণোদনার টাকা নিতে ভীষণ আগ্রহী।

এসব কারণে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করছে বলে ধারণা। তাদের সন্দেহ, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবছরের দিকে বেশ বেড়ে যাবে। এসব আশঙ্কা সত্য হলে তার ফল হবে মারাত্মক।

যাক, এসব ভবিষ্যতের কথা। বর্তমানের ভাবনা হচ্ছে জীবিকা। এক বছর অর্থাৎ ২০২০ সালটি আমাদের অর্থনীতির পাতা থেকে মুছে গেছে। এর লোকসান পোষাতে বহু সময় লাগবে। ইত্যবসরে ধনীরা টিকতে পারলেও ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা কীভাবে টিকবে সেটাই হচ্ছে বড় দুশ্চিন্তার বিষয়।

দেশে ৭০-৮০ লাখ ছোট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা আছে। তারা নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, খামার, সেবামূলক কাজ, কৃষি খামার ইত্যাদি করে ঘর-সংসার চালায়। তারা অসহায় ও অবহেলিত। তারা ব্যাংকের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারে না। অথচ তাদের ঋণ/সাহায্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। এ অর্থ সাহায্যটুকু পেলে তারা লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করতে পারবে।

মনে রাখা দরকার, অল্প পুঁজির একটা লেদ-মেশিনের কারখানাতেও ডজনখানেক শ্রমিক কাজ করে। একটা মুদি দোকানেও দুই-তিনজন কর্মচারী থাকে। এটা বড় বড় শিল্পে সম্ভব নয়। তারা সব স্বয়ংক্রিয় মেশিন বসাচ্ছে। বিলিয়ন বিলিয়ন (শতকোটি) টাকা বিনিয়োগ হলেও তাতে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে খুবই কম। আর বড়দের ঋণ পরিশোধের নজির বড়ই খারাপ। আমি নাম উল্লেখ করব না। বহু অতিপরিচিত বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন ঋণখেলাপি।

পথে বসার মতো অবস্থা। বহু ব্যবসায়ী টাকা মেরে বিদেশে পলায়ন করেছে। চট্টগ্রামের এক সময়ের বিখ্যাত ব্যবসায়ী হাউজগুলো এখন মামলার শিকার। তারা ঋণখেলাপি। ইস্পাত, লোহা, বস্ত্র, চিনি থেকে শুরু করে বহু শিল্পের বড় বড় কারখানা এখন পুরো উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে না। তারা ব্যাংকের উদারতায় ঋণ পেয়ে শুধু সম্প্রসারণই করেছে। অনেক বড় শিল্পের মালিক সেই শিল্প বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা শোধ করতে চায়, কিন্তু কোনো ক্রেতা তারা পাচ্ছে না। অনেক টাকার দরকার। বাস্তবে বড়দের সমস্যা বড়। এর সমাধান সহজ নয়। আমরা আবেগে অনেক কথা বলতে পারি। খেলাপি ব্যবসায়ীদের জেলে ঢোকাতে পারি, কিন্তু তাতে টাকা আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের ব্যাংকগুলোকে নজর দিতে হবে ছোট, মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতি। ব্যাংকাররা কি দয়া করে এ কাজটি করতে শুরু করবেন? এতে কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়। তারা বড়দের প্রতি অহেতুক খুব বেশি দৃষ্টিকটুভাবে ঝুঁকে পড়ায় দেশে এনজিওগুলোর একটা খাত তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যর্থতায় ছোট ছোট ঋণের জন্য তৈরি হয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংক, ছোট শিল্পঋণের জন্য বেসিক ব্যাংক। এসব এখন ইতিহাস।

সরকার অভিজ্ঞতার আলোকে ‘এনজিওগুলোকে’ অর্থাৎ মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে তৈরি করেছে ‘মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি’। সর্বশেষ একটি স্তরে দেখলাম সরকার ‘ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের’ (এমএফআই) মাধ্যমে ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে ১০ হাজার কোটি টাকার আরেকটি ‘প্রণোদনা’ নিয়ে আসছে।

এ টাকা ব্যাংকগুলো এমএফআইদের দেবে। সুদ ভর্তুকির টাকা ভাগাভাগি হবে এদের মধ্যে। এর জন্য বিস্তারিত নির্দেশিকাও তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় এটি ভালো পদক্ষেপ। এতে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ কমবে। বিপরীতে এমএফআইগুলো সচল হবে। তাদের নিবিড় মনিটরিংয়ে ঋণখেলাপের সমস্যাও কিছুটা কমবে। ছোটরা দ্রুত ঋণ পাবে।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *