নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা

শিক্ষা

স্বদেশবাণী ডেস্ক :নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। আগামী বছর প্রাথমিক স্তরের প্রথম শ্রেণি, মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এই শিক্ষাক্রমে লেখা নতুন পাঠ্যবই চালু করা হচ্ছে। সে লক্ষ্যে চলতি বছর এই প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক পাইলটিং (পরীক্ষামূলক পাঠদান) হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই প্রথম শ্রেণির বই তৈরির কাজ চলছে। আর ষষ্ঠ শ্রেণির বই মাত্র তিন মাসের পাইলটিংয়ের ওপর পাওয়া একটি খন্ডিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রচনা করা হয়েছে। এর ফলে পরীক্ষামূলকভাবে চালুর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত প্রয়োজনীয় ‘ফল’ বা ‘প্রভাব’ না জেনেই নতুন পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে।

এদিকে আগামী মাসের শেষ সপ্তাহে নতুন শিক্ষাক্রমে রচিত প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবই পাইলটিং শুরু করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে ১ জানুয়ারি এই বই বিতরণের লক্ষ্যে তা মুদ্রণে দরপত্র ডাকছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এই অবস্থায় এই পাইলটিং নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, এই পাইলটিংয়ের প্রভাব বা ফল নতুন বইয়ে যুক্ত করার কোনো সুযোগ থাকছে না। ফলে এই খাতে বরাদ্দ কোটি টাকা কেবল খরচের লক্ষ্যেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কেবল প্রথম ও ষষ্ঠ নয়, সপ্তম শ্রেণিতেও আগামী বছর নতুন শিক্ষাক্রমে লেখা পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে। এখন বইগুলোর ‘পরীক্ষামূলক সংস্করণ’ যাবে। এরপর সারা বছর ধরে এর ওপর শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হবে। এর নাম ‘ট্রাইআউট’। এই ট্রাইআউটের ফল অনুযায়ী পরের বছর বা ২০২৪ সালে চূড়ান্ত পাঠ্যবই দেওয়া হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন এনসিটিবির দুজন সদস্য। তাদের মধ্যে একজন অধ্যাপক মশিউজ্জামান। তিনি বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণির বই রচনায় প্রথম ধাপের পাইলটিংয়ের প্রতিবেদন ইতোমধ্যে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। মোট তিন ধাপে তিনটি প্রতিবেদন আসার কথা। বই মুদ্রণে পাঠানোর আগে দ্বিতীয় প্রতিবেদন চলে আসবে। ওই প্রতিবেদনটিও তখন বিবেচনায় নেওয়া হবে। আর প্রাথমিকের ‘অযথা’ পাইলটিং প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিটিবির অপর সদস্য অধ্যাপক ড. রিয়াজুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তক্রমে তারা এই পাইলটিং করছেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগস্টের শেষ সপ্তাহে বা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাইলটিং শুরু হবে। ডিসেম্বর পর্যন্ত এটি চলবে। তবে আগামী বছর পরীক্ষামূলক সংস্করণে যাবে। এর আগে ২০১২ সালেও এমনটি করা হয়েছে।

জানা গেছে, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি) থেকে নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই বাস্তবায়নের অর্থায়ন করা হচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই ও শিক্ষক নির্দেশিকার জন্য প্রায় ২ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি টাকা প্রাথমিকের বই তৈরি বাবদ প্রশিক্ষণসহ নানান খাতে ব্যয় হয়েছে। বাকি টাকা পাইলটিংয়ের বই মুদ্রণে ব্যয় হবে। এছাড়া পাইলটিংয়ের জন্যও আলাদা ব্যয় আছে। সবমিলে প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে এ খাতে। অন্যদিকে যেহেতু আগামী বছর পরীক্ষামূলক সংস্করণ যাচ্ছে, তাছাড়া বছরের শেষে এই পাইলটিংয়ে শিক্ষার্থীরাও খেই হারিয়ে ফেলবে তাই এই পাইলটিংয়ে ‘অযথা’ই অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই দেওয়া হয়। সারা বছর শিক্ষার্থীরা তা পড়ে এবং এক বছরে নির্ধারিত শিখনফল অর্জন করে। সেই লক্ষ্যে এবার ষষ্ঠ শ্রেণির যে বইগুলোর পাইলটিং চলছে, সেগুলোও বছরের শুরুতেই দেওয়া হয়। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে ১ জানুয়ারির পরিবর্তে গত ২২ ফেব্রæয়ারি ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার আগে এটির প্রথম অংশের লেখাপড়া শেষ হয়। এখন দ্বিতীয় অংশের পাঠদান শুর্নু হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মধ্যে বইয়ের তৃতীয় বা শেষ অংশের ওপর পরীক্ষামূলক পাঠদান দেওয়া হবে। সাধারণত বছরের শেষের দিকে পাঠ্যবইয়ের শেষ অংশ পড়ানো হয়।

এ অবস্থায় নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে দুটি প্রশ্ন উঠেছে, প্রথমত, প্রাথমিক স্তর প্রথম শ্রেণির পাইলটিংয়ের পাঠ্যবই বছরের শেষের দিকে দিলে বইয়ের কোন অংশ শিক্ষার্থীদের পড়াবে? তাছাড়া বছরের ৮ মাস পুরোনো শিক্ষাক্রমে পড়ে হঠাৎ করে শেষ তিন মাসে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা কীভাবে ও কী পড়বে? দ্বিতীয়ত, ষষ্ঠ শ্রেণির পাইলটিংয়ের একটি মাত্র প্রতিবেদনের ওপর আগামী বছরের বই তৈরি করা হয়েছে। এটি যথেষ্ট কিনা? কেননা এতে নতুন শিক্ষাক্রমের ‘প্রভাব’ সম্পর্কিত প্রকৃত চিত্র উঠে না আসার সম্ভাবনাই বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের পাইলটিংয়ে সংশ্লিষ্ট আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান। উল্লিখিত দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণির বই সারা বছরকে তিন ভাগ করে পাইলটিং করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম অংশের প্রতিবেদনের ওপর বই লেখা হলেও দ্বিতীয় প্রতিবেদনের ফিডব্যাক (প্রভাব বা ফল) বই মুদ্রণে যাওয়ার আগে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এতে মূল লক্ষ্য অনেকটাই অর্জিত হবে। তিনি আরও বলেন, তিনটি প্রতিবেদনের ফলই যুক্ত করতে না পারার কারণেই ‘চূড়ান্ত’র পরিবর্তে ‘পরীক্ষামূলক’ বই তারা আগামী বছর দিচ্ছেন। একই সঙ্গে সপ্তম শ্রেণিরও পরীক্ষামূলক সংস্করণ দেওয়া হবে। ২০২৪ সালে এই দুই শ্রেণির চূড়ান্ত সংস্করণ যাবে স্কুলে।

আর প্রথম প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক হাসান বলেন, সারা বছর ধরে পাইলটিং হওয়ার কথা ছিল। নতুন বই লেখার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট সংকট ছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এজন্য মন্ত্রণালয়ে অর্থ চাওয়া হয়। কিন্তু অনুমোদন পাওয়া গেছে এপ্রিলে। টাকা পাওয়ার পর বই লেখা শুরু হয়েছে মে মাসে। এ কারণেই এমন পরিস্থিতি হয়েছে। তিনি আরও জানান, এখন পাইলটিং হলেও আগামী বছর প্রথম শ্রেণির বই পরীক্ষামূলক সংস্করণই যাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বইয়ের পরীক্ষামূলক সংস্করণ যাবে ২০২৪ সালে আর ২০২৫ সালে পঞ্চম শ্রেণির বই। পরীক্ষামূলক সংস্করণে সারাবছর বই সম্পর্কে মতামত নেওয়া হবে। এর ভিত্তিতে পরে চূড়ান্ত বই দেওয়া হবে।

স্ব.বা/রু

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *