আবরারের খুনিদের বিচার দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি * আন্দোলনের প্রভাব পড়েনি পরীক্ষায় -ভিসি * ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার * স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে বুয়েটের চিঠি
স্বদেশ বাণী ডেস্ক: শোকাবহ বুয়েট ক্যাম্পাসে চলতি শিক্ষাবর্ষের স্নাতক শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা সোমবার সকাল ৯টায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে শনিবার ভর্তি পরীক্ষাকে সামনে রেখে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে টানা আন্দোলন শিথিল করে আন্দোলনকারীরা।
১৩ ও ১৪ অক্টোবর চলমান আন্দোলন শিথিলের মধ্যে সব দাবি মানার সিদ্ধান্ত দৃশ্যমান করতে বুয়েট প্রশাসনের প্রতি আহ্বান ছিল আন্দোলনকারীদের। তবে তারা পরীক্ষার মধ্যেও খুনিদের বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। আজ মঙ্গলবার দাবি আদায়ে ফের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তারা।
এদিকে পরীক্ষা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি পুরোটা সময় শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে কাজ করছেন। শিক্ষার্থীরাও প্রশাসনের কথা শুনেছে বিধায় চলমান আন্দোলনের কোনো প্রভাব ভর্তি পরীক্ষায় পড়েনি।
যোগ্য আবেদনকারীর ৯০ ভাগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। ভিসি বলেন, ছাত্ররা আমার সন্তানের মতো। তারা আমাদের কথা শুনেছে বলেই ভর্তি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়েছে। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। তাদের দাবিগুলো পূরণেও আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কমিটি হয়েছে। তারাও কাজ করছে।
দুই দিনে দাবি পূরণে দৃশ্যমান অগ্রগতির বিষয়ে অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য যা করার করে যাচ্ছি। আজকের দিনটিতে (রোববার) আমাদের পরীক্ষায় বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছে।
দাবি পূরণ না হলে আন্দোলনকারীরা মাঠ ছাড়বেন না- এমন ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে ভিসি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলব। আমরা বসে নেই, শিক্ষার্থীদের জন্যই কাজ করছি। অভিভাবকদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে- এ বিষয়ে ভিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা যতটুকু পারছি, করছি। আবাসিক হলগুলোয় বহিরাগতরা যাতে না থাকতে পারে, সেজন্য কাজ করছি। নিয়মিত শিক্ষার্থীর বাইরে কেউ হলে থাকতে পারবে না।
এ বছর বুয়েটে ৫টি অনুষদ ও ১২টি বিভাগের বিপরীতে ভর্তির জন্য ১৬ হাজার ২৮৮টি আবেদন পড়েছিল। এর মধ্যে ১২ হাজার ১৬১ শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য যোগ্য বিবেচিত হন। এর মধ্যে ৮ হাজার ৮৯৬ জন ছাত্র ও ৩ হাজার ২৬৫ জন ছাত্রী।
ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের মাধ্যমে মেধা অনুযায়ী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবেন ১ হাজার ৬০ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ৫ জন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ও ৫৫ জন আর্কিটেকচার বিভাগে ভর্তি হতে পারবেন।
খুনিদের বিচার দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি : সকাল ৯টা থেকে তিন ঘণ্টার লিখিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা শেষ হয় দুপুর ১২টায়। কেবল আর্কিটেকচারে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য এই তিন ঘণ্টার বাইরে দুপুর ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার আরেকটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে আবরার ফাহাদ হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন আন্দোলনকারীরা।
ভর্তি পরীক্ষার কারণে সকাল থেকেই বুয়েট ক্যাম্পাসে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা ভিড় করেন। এর মধ্যেই ক্যাম্পাসে শহীদ মিনারের সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কর্মসূচি পালিত হয়। আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি পালিত হয়। সেখানে অনেক শিক্ষার্থীকেই স্বাক্ষর করতে দেখা যায়। দাবির বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলেও জানান তারা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সাইদুল আরাফাত বলেন, আমরা শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্দোলন করছি। সব দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেয়ার পরও আন্দোলন কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশ্বাস বা ঘোষণা নয়, আমরা দাবির বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
খুনিদের বিচার দাবি অভিভাবকদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে চিঠি দেয়ার কথা জানালেন ভিসি : এদিকে ভিসি যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন একজন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর অভিভাবক এসে তার উদ্দেশে বলেন, সারা দেশের মানুষ আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আবরার হত্যার বিচার হতেই হবে। আমরা ভীষণভাবে আহত। তখন ভিসি বলেন, আমরা দুঃখিত। আমরাও কষ্ট পাচ্ছি। এই বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তদারকি করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাল (রোববার) এনশিওর করেছেন সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে চিঠি দিচ্ছি।
শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ভিসি বলেন, এ নিয়ে আমাদের সরকারের সঙ্গে কথা হচ্ছে। সবকিছু তো আমার হাতে নেই। এ ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা পাওয়া যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি, সরকারও বুঝতে পারবে।
ছাত্রলীগ নেতা অমিতকে সংগঠন থেকে স্থায়ী বহিষ্কার : আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহাকে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। অমিতের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ‘অধিকতর তদন্তে’ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে ছাত্রলীগ। সোমবার ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অমিত সাহাকে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বুয়েটের সাম্প্রতিক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি করে। ওই কমিটির অধিকতর তদন্তে উঠে এসেছে, অমিত সাহা ওই ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথোপকথনের মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অধিকতর তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হল।
অমিত সাহা বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের যে কক্ষে (২০১১ নম্বর) আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, অমিত সেই কক্ষের অন্যতম বাসিন্দা।
নটর ডেম শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার বিচার চেয়ে রাজধানীর মতিঝিলে সোমবার দুপুরে বিক্ষোভ করেছেন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১টার দিকে শিক্ষার্থীরা কলেজ ড্রেস পরে নটর ডেম কলেজের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হন।
মিছিলটি শাপলা চত্বরে এলে সেখানে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। শাপলা চত্বরে রাস্তার ওপর বসে ও দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। ‘ফাঁসি ফাঁসি, ফাঁসি চাই, হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই,’ ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে,’ ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘আর নয় অনাচার, এবার চাই সুবিচার’- শিক্ষার্থীদের এ ধরনের স্লোগানে কম্পিত হয়ে ওঠে মতিঝিল এলাকা।
শাপলা চত্বর মোড়ে পুলিশ পাহারায় মিনিটদশেক বিক্ষোভ করার পর শিক্ষার্থীরা আবার মিছিল করতে করতে নটর ডেম কলেজের সামনে ফিরে যান। বিক্ষোভে অংশ নেয়া একাধিক শিক্ষার্থী জানান, তারা ক্লাস শেষ করে আবরার ফাহাদের হত্যার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে এই বিক্ষোভের আয়োজন করেন। সূত্র: যুগান্তর।
স্ব.বা/শা