অজপাঁড়াগায়ের সেই উর্মি এখন মেডিকেল কলেজে

শিক্ষা

আব্দুল হামিদ মিঞা,বাঘা (রাজশাহী): যৌথ পরিবারের টানপোড়নের সংসারে রয়েছে ঋণ। ৬মাস আগেও এক শিক্ষার্থীর নামে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন পরিবার। তারপরেও থেমে থাকেনি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া উরপীতা খাতুন উর্মি।

জানা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করলেও টানপোড়নের সংসারে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মা-বাবা। কিন্তু লেখাপড়া করে বড় কিছু হওয়ার আগ্রহটা ছিল শিক্ষার্থীর। সেই কথাটা বলেছিলেন সাক্ষরজ্ঞান দাদির কাছে। তার সেই ইচ্ছা পূরণে বিয়েতে বাঁধ সেধেছিলেন দাদি। তিনি শিক্ষার্থীর মা-বাবাকে বলেছিলেন তোমরা লেখাপড়ার খরচ চালাতে না পারলেও যেভাবেই হোক টাকার যোগান আমি দিব। দাদির এমন অনুপ্রেরণায় ভর্তি হয়েছিলেন গ্রামের কলেজে। সেই কলেজে পড়েই ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন অজপাড়া গাঁয়ের কৃষক পরিবারের সেই উরপীতা খাতুন উর্মি। ১০০ নম্বরের ১ ঘন্টার এমসিকিউ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৬৭ দশমিক ৭৫ নম্বর পেয়ে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।

ভর্তি হতে হবে এ মাসের ২০ ও ২২ তারিখে। তাতে টাকা লাগবে সাড়ে ২২(বাইশ) হাজার। এজন্য জমিও লিজ দিয়েছেন তার বাবা। তাতেও রয়ে গেছে সমস্যা। পরিবারটির নতুন করে ঋণ নেওয়ার জায়গাও নেই।
উরপীতা খাতুন উর্মি, নিজ এলাকার দিঘা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উপজেলায় সেরা হন। ২০১৪ সালে নিজ গ্রামের ধন্দহ অমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পার্শ্ববর্তী নাটোরের লালপুর উপজেলার বোয়ালিয়াপাড়া এম .এম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ভালো ফলাফলে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ বাড়ে তার। দাদি হাতের কাজ আর মা বাড়িতে হাঁসমুরগি পালন করে টাকা যুগিয়েছেন। উপায় না পেয়ে বিআরডিবি থেকে শিক্ষার্থীর নামে ঋণও করতে হয়েছে।

উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে উরপীতা খাতুন উর্মি বলেন,ব্যক্তিগত জীবনে মা-বাবা,চাচার পরে দাদি আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। সব বিষয়েই দাদির সাপোর্ট বেশি পেয়েছি। মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতির সময় হতাশায় থাকতাম। তখন আমাকে সাহস যুগিয়েছেন। তাদের সহযোগিতাই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপান্তর করার চেষ্টা করেছি। আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার মধ্যে আমি প্রথম ডাক্তার হতে যাচ্ছি। মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়ে উচ্চুসিত উর্মি তার এ সাফল্যের পথে হাত বাড়ানো সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।

তিনি জানান,অস্বচ্ছল সংসারে মা-বাবার কাছে কিছু চাইতে পারেননি। দাদি রেহেনা বেগমের সঞ্চিত কিছু টাকা নিয়ে রাজশাহীতে এক আত্নীয় বাসায় থেকে রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে কোচিং করেছেন। সেই বাসা থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দুরে কোর্চিং করেছেন বেশিরভাগ সময় পাঁয়ে হেঁটে। কোচিং এ যাবার সময় যে বাটুল ফোনটি হাতে দিয়েছিলেন,সেটি তার ছোট ফুফু দাদিকে দিয়েছিলেন। ফোনে টাকা রিসার্চ না করে শুধুমাত্র বাড়ির ফোনের অপেক্ষায় থাকতেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেচিকিৎসক হয়ে দরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে সেবা দেওয়ার পণ করেছেন উর্মি। প্রাইভেট পড়ায়ে টাকা-পয়সা নিতেন না শিক্ষকরা। দিঘা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম বলেন, উর্মি খুবই মেধাবী ছাত্রী। তার কৃতিত্বে আমরা গর্বিত।

উরপীতা খাতুন উর্মি,রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের ধন্দহ গ্রামের আতাউর রহমান ও গৃহিনী হাফিজা বেগমের ১ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে বড়। তার ছোট ভাই সিফাত রহমান লালপুর উপজেলার বোয়ালিয়াপাড়া এম .এম উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯বম শ্রেণীতে লেখাপড়া করে।

সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) উর্মিদের বাড়িতে গেলে,তার মা হাফিজা বেগম বলেন, মেয়ের সামান্য চাহিদাও পূরণ করতে পারিনি। পড়ালেখার ইচ্ছা ছাড়া তার মেয়ের বিশেষ কোন চাহিদা ছিলনা।

দাদি রেহেনা বেগম বলেন, তার চিকিৎসক হওর্য়ার ইচ্ছাটা ছিল প্রবল। আল্লাহ উর্মির সেই ইচ্ছা পূরণ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, নাতনির বিশেষ প্রয়োজনে মা-বাবার দিকে চেয়ে থাকিনি। তাকে যে ফোনটা দিয়েছি,সেটা আমার ছোট মেয়ে আমাকে দিয়েছিল। তার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য পরে তাকে দিয়ে দিছি।

মেয়ে একজন মানবিক চিকিৎসক হলেই সার্থক হবে সবার চেষ্টা-এমনটাই প্রতাশা বাবা আতাউর রহমানে। তিনি জানান, দুই ভাইয়ের যৌথ পরিবার। মা-বাবাসহ মোট লোকসংখ্যা ১০জন। পৈত্রিক সূত্রে দেড় বিঘা করে মোট ৩বিঘা জমির মালিক তিনি ও তার ছোট ভাই মতিউর রহমান। সেই জমির আয়ে সংসার চলেনা। অন্যর জমি বর্গা নিয়ে দুই ভাই মিলে চাষাবাদ করেন।

ভাতিজির সাফল্যে মতিউর রহমান বলেন, সে (উর্মি) আমাদের গর্ব। প্রাথমিকে ভর্তির পর থেকেই ভালো ফলাফলে উৎসাহিত করেছি। সর্বোপরি সকলের সহযোগিতায় তার প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছে,এতে অন্যরকম এক শান্তি অনুভব হচ্ছে।

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *