স্বদেশ বাণী ডেস্ক: দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সর্ববৃহৎ উপাদান হলো দেশের কৃষি ব্যবস্থা। আর এ ক্ষেত্রে কৃষি ব্যবস্থাকে একের পর এক নতুন উদ্যমে গড়ে তুলতে কাজ করছেন দেশের অসংখ্য বিজ্ঞ কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীগণ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, পাট গবেষণা কেন্দ্র, ধান গবেষণা কেন্দ্র, বিএডিসিসহ দেশের বেশ ক’টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ সেক্টরের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নতুন নতুন কলাকৌশল আবিষ্কার ও বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা অনেকটাই সেচ নির্ভরশীল। শুধুই ধানের আবাদ নয়; সব ফল-ফসলেই ক্ষেত্রমতে পানি সেচের প্রয়োজন হয়। সেচ সংকটের কারণে স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা তথা ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ সংকট দেখা দিলে দেশে চরম খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিএডিসি (সেচ) স্থাপনের মাধ্যমে বিদেশ থেকে গভীর নলকূপ আমদানি করে সারাদেশের কৃষির মাঠে স্থাপন করেন। এরই মাধ্যমে বাংলাদেশের ফসলের মাঠে সেচ ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটে। পর্যায়ক্রমে সেচ ব্যবস্থার দেশে বিদ্যমান বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
ধান ও ফল-ফসল উৎপাদনের জন্য যেমন পরিমিত সেচ ব্যবস্থা প্রয়োজন, তেমনি জমির উর্বরতা বজায় রাখতেও পরিমিত সেচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেচের মাধ্যমে গভীর নলকূপ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন অথবা খাল, বিল, নদী-নালার পানি উত্তোলন যেটাই করা হোক না কেন, এজন্য জ্বালানি হিসেবে তেল, মবিল, গ্যাস বা বিদ্যুতের প্রয়োজন। প্রয়োজনের বেশি পানি উঠাতে গেলে জ্বালানি ও বিদ্যুতেরও ব্যাপক অপচয় ঘটে। বাংলাদেশে আউশ, আমন, ইরি ও বোরো ধান আবাদের ক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে বোরো ধান আবাদেই এখন দেশের খাদ্য চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করে। এজন্য দেশে ইরি-বোরো আবাদের মাত্রা ব্যাপক বেড়েছে। ইরি-বোরো আবাদের ক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থার জন্য ভূগর্ভস্থ বা নদী-খাল থেকে সেচের মাধ্যমে প্রয়োজনের বেশি পানি উঠালে ফসলের উৎপাদন কম হয় ও জমির উর্বরতাও হ্রাস পায়। তাছাড়া বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ করতে হয়। এজন্য বোরো আবাদের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের চরম ঘাটতির খবর পাওয়া যায়।
এসব কথা বিবেচনায় রেখে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ডায়িং পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। যাতে বোরো ধান চাষে ৪০ ভাগ পানি সাশ্রয় হবে এবং ২০ শতাংশ উৎপাদন বাড়বে। পরিমিত পরিমাণ সেচ ব্যবস্থার পদ্ধতি পূর্ব থেকেই কৃষক পর্যায়ে প্রচলিত ছিল। ধান ক্ষেতে পানি সাশ্রয়ের জন্য কৃষকদের উদ্ভাবিত একটি সনাতন পদ্ধতির নাম ‘পিঠ দেওয়া’ বা ফসলের মাঠ পর্যায়ক্রমে শুকানো ও সেচ দেওয়ার মাধ্যমে পানি সাশ্রয় করা। এতে ফসলের ফলন বাড়ে আর এ পদ্ধতির আধুনিক রূপায়ন বর্তমান উদ্ভাবিত পদ্ধতিটি। যা ন্যাশনাল এগ্রিকালচার টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেজ (এনএটিপি-২) প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এডব্লিউডি পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি হচ্ছে, সেচে পানির অপচয় রোধে এটি একটি পরীক্ষিত ও কার্যকরী কৃষি প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্য হলো ধানচাষের জমিতে সব সময় পানি না রেখে পর্যায়ক্রমে জমি ভেজা ও শুষ্কপদ্ধতি অনুসরণ করা। আর এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করাই এ প্রযুক্তির কাজ। এটি একটি সহজ ও স্বল্প খরচে ব্যবহার উপযোগী প্রযুক্তি। যা ব্যবহারে পিভিসি পাইপ অথবা বাঁশের চোঙ্গা দ্বারা ছিদ্রযুক্ত পর্যবেক্ষণ নল তৈরি করতে হয়। নলের ব্যাস ৭-১০ সেন্টিমিটার এবং নলটি ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা হতে হয়। নলের নিচের দিকের ২০ সেন্টিমিটার ছিদ্রযুক্ত এবং উপরের দিকের ১০ সেন্টিমিটার ছিদ্রবিহীন থাকে। নলের গায়ে ১০ মিলিমিটার দূরে ৫ মিলিমিটার ব্যাসের ছিদ্র থাকে। এক সারি ছিদ্র থেকে আরেক সারি ছিদ্রের দূরত্ব হবে ১০ মিলিমিটার।
জমিতে নলটি এমনভাবে স্থাপন করতে হয়, যেন ছিদ্রযুক্ত ২০ সেন্টিমিটার অংশটুকু মাটিতে এবং ছিদ্রবিহীন ১০ সেন্টিমিটার অংশ মাটির উপরে থাকে। স্থাপনের সময় পাইপ বা নলটি দু’হাতে চাপ দিয়ে মাটিতে ঢোকাতে হয়, যাতে মাটির চাপ থাকে। তারপর পাইপের ভেতরের মাটি ভালোভাবে সরিয়ে ফেলতে হয়।
ধানের জমিতে চারা রোপণের ১৫ দিন পর্যন্ত ২-৪ সেন্টিমিটার দাঁড়ানো পানি রাখতে হয়, যাতে আগাছা কম জন্মে। চারা রোপণের ১৫ দিন পর জমিতে এডব্লিউডি পদ্ধতি অনুসরণ করে সেচ দিলে পানি অপচয় রোধ হয়। জমিতে সেচ দিয়ে নলের ভেতরে পানির মাত্রা পরিমাপ লক্ষ্য রাখতে হয়। ক্ষেতের দাঁড়ানো পানি শুকিয়ে পাইপের তলায় নেমে গেলে আবার সেচ দিতে হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ দিতে হয়।
দেশে বোরো ধানের জমিতে পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যে কৃষকদের আগ্রহী করতে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিশীর্ষক প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি প্রদর্শনীর মাধ্যমে এডব্লিউডি প্রযুক্তিটি দেশের সব কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা চালাচ্ছে। কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় এবং কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে যেসব কৃষক তাদের বোরো আবাদে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ দিচ্ছেন, তাদের প্রায় ৩০% সেচ সাশ্রয় হচ্ছে বলে কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা মনে করছেন। বোরো আবাদে সেচ কম লাগায় কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
কৃষিবিদদের মতে, বিনা প্রয়োজনে জমিতে সেচ দেওয়ার কোনো দরকার নেই। বোরো ধানের জমিতে পানি ১৫ সেন্টিমিটারের নিচে চলে গেলে তবেই সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এতে কয়েকদিন পরপর জমিতে অতিরিক্ত সেচ দিতে হয় না। এতে সেচ ব্যয় কমে এবং পানির সদ্ব্যবহার হয়। তাই এ প্রযুক্তি কৃষি উন্নয়নে আরও অগ্রগতি হবে বলে কৃষিবিদরা আশা করেন। এতে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। সূত্র: জাগো নিউজ।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ধান চাষের জন্য অনবরত দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই; বরং সেচ দেওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শুকিয়ে আবার সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে ক্ষেতে আগাছাও কম হয়। আশা করা যায়, প্রযুক্তিটির ব্যবহার প্রচলন বৃদ্ধি পেলে দেশের কৃষকরা কৃষিতে তথা ফসল উৎপাদনে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবেন।
লেখক: ডিপ্লোমা কৃষিবিদ ও উদ্যোক্তা।
স্ব.বা/শা